মানুষের যে গুণ জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম
উত্তম চরিত্র ঈমানকে পরিপূর্ণ করে। চারিত্রিক সৌন্দর্য অর্জন না করে ঈমানের সৌন্দর্য অর্জন সম্ভব নয় এবং নিজে যেমন হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়া সম্ভব নয়, তেমনি অন্যকেও হেদায়েতের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে মহান আল্লাহ তার রাসুলকে সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’ -সুরা ক্বলাম : ৪
মহৎ চরিত্র কী- এর অর্থ নির্ধারণে কয়েকটি অভিমত আছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মহৎ চরিত্রের অর্থ মহৎ দ্বীন। কেননা আল্লাহর কাছে ইসলামের চেয়ে বেশি প্রিয় কোনো দ্বীন নেই।’
উত্তম চরিত্র মানুষকে আল্লাহর প্রিয় করে তোলে। যার চরিত্র যত সুন্দর, সে আল্লাহর কাছে তত বেশি প্রিয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তারা, যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ -জামিউস সগির : ২১৮
চারিত্রিক উৎকর্ষ অর্জনের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। তাদেরকে আল্লাহতায়ালা এতই ভালোবাসেন যে, তাদের দিনের বেলায় রোজা ও রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের সমপরিমাণ মর্যাদা দান করেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয়ই মুমিন তার ভালো চরিত্রের মাধ্যমে (দিনের) রোজা পালনকারী ও (রাতের) তাহাজ্জুদ আদায়কারীর সমান মর্যাদা লাভ করতে পারে।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৪৭৯৮
জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হলো উত্তম চরিত্রবান হওয়া। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আল্লাহভীতি, সদাচরণ ও উত্তম চরিত্র। আবার তাকে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান। -জামে তিরমিজি : ২০০৪
অন্য হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মিজানের পাল্লায় সচ্চরিত্রের চেয়ে অধিক ভারী আর কিছুই নেই।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৪৭৯৯
হজরত আবু উমামা আল-বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের উপকণ্ঠে একটি ঘর দেওয়ার জন্য জামিন হচ্ছি, যে সত্যাশ্রয়ী হওয়া সত্ত্বেও কলহ-বিবাদ বর্জন করে। সেই ব্যক্তির জন্য আমি জান্নাতের মধ্যস্থলে একটি ঘরের জামিন হচ্ছি, যে উপহাসছলেও মিথ্যা বলা বর্জন করে। আর সেই ব্যক্তির জন্য আমি জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটি ঘরের জামিন হচ্ছি, যার চরিত্র সুন্দর।’ -সুনানে আবু দাউদ
হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামত দিবসে মুমিনের দাড়িপাল্লায় সচ্চরিত্র ও সদাচারের চেয়ে বেশি ওজনের আর কোনো জিনিস হবে না। কেননা, আল্লাহ অশ্লীল ও কটূভাষীকে ঘৃণা করেন।’ -সুনানে তিরমিজি
তাই আমাদের উচিত, উত্তম চরিত্র গঠনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। রাসুল (সা.) যেভাবে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, সেভাবে চলা। সত্যবাদী হওয়া, আমানতের ব্যাপারে সচেতন হওয়া, নম্র হওয়া, মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, কারো সঙ্গে অঙ্গীকার করলে তা পূরণ করা, প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, বিপদে ধৈর্য ধারণ করা, লজ্জাবতী হওয়া, ন্যায়পরায়ণ হওয়া, দয়ালু হওয়া, অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা।
হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার গঠন ও আকৃতি যে রকম সুন্দর করেছ, আমার চরিত্রকেও অনুরূপ সুন্দর করো।’ -মুসনাদে আহমাদ
হজরত লোকমান (আ.) নিজ সন্তানকে বলেন, ‘হে বৎস! শিষ্টাচারিতা মিরাসের (উত্তরাধিকার সম্পদ) চেয়েও উত্তম, উত্তম চরিত্র শ্রেষ্ঠ সঙ্গী, আল্লাহর তওফিক সেরা পরিচালক, আর সাধনা অধিক লাভজনক পুঁজি। বিবেক-বুদ্ধির চেয়ে অধিক উপকারী সম্পদ নেই, পরামর্শের চেয়ে অধিক সহযোগী কিছু নেই, আত্মতৃপ্তির চেয়ে অধিক বিষাদময় এককীত্ব নেই, অজ্ঞতার চেয়ে চরম অভাবের আর কিছু নেই এবং জ্ঞানের স্বল্পতার চেয়ে অধিক শূন্যতার কিছু নেই।’
হজরত আহনাফ (বিন কায়েস) বলেন, ‘আমি কি তোমাকে ক্ষতিহীন প্রশংসনীয় কাজের কথা বলব না? তা হলো- সদাচরণ করা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। আমি কি তোমাকে সবচেয়ে খারাপ রোগের কথা বলব না? তা হলো- হীন চরিত্র ও অশ্লীল ভাষা।’
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র থাকার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখবেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করার চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা প্রদান করবেন। আর যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষিতা অবলম্বন করবে, আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করবেন।’ -সহিহ বোখারি
হজরত আবদুর রহমান বিন মাহদি (রহ.) বলেন, ‘একজন ব্যক্তি যেন হারাম থেকে বেঁচে থাকার ন্যায় খারাপ চরিত্র থেকে বেঁচে থাকে।’ হজরত ইবনে হিব্বান (রহ.) বলেন, ‘অনেক সময় একজন ব্যক্তির মাঝে সকল ভালো চরিত্র থাকে আর এর সঙ্গে একটিমাত্র খারাপ চরিত্র থাকে, ফলে এই খারাপ চরিত্রটি তার সকল ভাল চরিত্রগুলোকে নষ্ট করে দেয়।’
নাওয়াস বিন সামআন আল-আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তখন তিনি জবাব দিলেন, ‘পুণ্য হলো- উন্নত চরিত্র। আর পাপ হলো- যা তোমার অন্তরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং লোকে তা জানুক তা তুমি অপছন্দ করো।’ -সহিহ বোখারি