নামাজে মনোযোগ বাড়ানোর কার্যকর উপায়
যেকোনো আমল ও ইবাদত-বন্দেগির সঙ্গে চিন্তা-ভাবনার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই শারীরিক ইবাদতের পাশাপাশি মনোযোগ ও ধ্যানমগ্ন হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য দু-দুজন বা এক-একজন করে দাঁড়াও। অতঃপর চিন্তা-ভাবনা করো।’ -সুরা সাবা : ৪৬
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, ইবাদত-বন্দেগি পালনের সময় চিন্তা করে দেখতে হবে- আমি কতটুকু মনোযোগী হয়ে ইবাদত করছি, ইবাদত সুন্নত মোতাবেক হচ্ছে কি না, কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হচ্ছে কি না, এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হচ্ছে কি না ইত্যাদি।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রেখো! আল্লাহ গাফেল (উদাসীন) ও অমনোযোগী মনের দোয়া কবুল করেন না।’ -জামে তিরমিজি : ৩৪৭৯
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (সা.) বলেন, ‘অমনোযোগী হয়ে সারা রাত নফল নামাজ আদায় করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনাসহ দুই রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম।’ -ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ৪/৪২৫
ইবাদতসমূহের মাঝে নামাজ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নানাবিধ কারণে মানুষ নামাজে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়। এ প্রেক্ষিতে ইসলামি স্কলাররা বলেন, নামাজে মনোযোগ তখনই আসবে, যখন আমরা বুঝব যে, নামাজে আমরা কি বলছি। যখন আমরা নামাজে বলা দোয়া, তাসবিহ ইত্যাদির অর্থ বুঝব, সেগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করব; তখন মনের মাঝে স্বাভাবিকভাবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটবে এবং আমাদের নামাজ আরও বেশি সুন্দর ও খাঁটি হবে।
নামাজের সময় আমরা যা বলি, তার অর্থ জানলে নামাজে অন্য চিন্তা মাথায় আসবে না। নামাজের নিয়ত করার পর, নামাজের মধ্যে যেসব তাসবিহ, দোয়া-দরুদ আমরা পড়ি বা বলছি সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১. নামাজে দাঁড়িয়েই প্রথমে আমরা বলি- আল্লাহু আকবার। অর্থ : আল্লাহ সবচেয়ে বড়।
২. তারপর সানা পড়ি- সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা ওয়াতা-বারাকাসমুকা ওয়াতায়ালা জাদ্দুকা ওয়ালা ইলাহা গাইরুকা।
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি পাক-পবিত্র, তোমার জন্য সমস্ত প্রশংসা, তোমার নাম পবিত্র এবং বরকতময়, তোমার গৌরব অতিউচ্চ, তুমি ছাড়া অন্য কানো উপাস্য নাই।
বস্তুত সানায় আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি এবং নিজের জন্য দোয়া করি।
৩. তারপর কেরাত পড়ার শুরুতে আমরা অভিশপ্ত শয়তানের প্রতারণা থেকে আশ্রয় চাই এবং বলি, আঊজু বিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজিম। অর্থ : বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
৪. এর পর মহান আল্লাহর পবিত্র নাম দিয়ে আল্লাহর দয়া ও করুণা চাওয়ার মাধ্যমে নামাজ এগিয়ে নিয়ে যাই এবং বলি, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। অর্থ : পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি।
৫. এর পর আমরা সুরা ফাতেহা দিয়ে নামাজ শুরু করি (২ রাকাত, ৪ রাকাত, ফরজ বা সুন্নতের নিয়ম অনুযায়ী নামাজ পড়ি)।
৬. আমরা রুকুতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে শরীর অর্ধেক ঝুঁকিয়ে দিয়ে মাথা নুইয়ে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করি এবং ক্ষমা চাই- তিন বার বলি, সুবাহানা রাব্বিয়াল আজিম। অর্থ : আমার মহান রবের পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি।
৭. তারপর রুকু থেকে উঠে আমরা বলি- সামিআল্লাহু লিমান হামিদা। অর্থ : আল্লাহ সেই ব্যক্তির কথা কবুল করেন, যে তার প্রশংসা করে।
তারপর পরই আমরা আবার আল্লাহর প্রশংসা করে বলি, রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ। অর্থ : হে আল্লাহ! যাবতীয় প্রশংসা কেবল তোমারই।
৮. তারপর আমরা সমস্ত শরীর নুইয়ে, মাথা মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট সিজদা দেই। তিনবার বলি- সুবহানা রাব্বিয়াল আলা। অর্থ : আমার মহান রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছি।
৯. দুই সিজদার মাঝখানে বলি- আল্লাহুম্মাগ ফিরলি, ওয়ারহামনি, ওয়াহদিনি, ওয়াআফিনি, ওয়ারঝুকনি।
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি আমায় মাফ কর, আমাকে রহম কর, আমাকে হেদায়েত দান কর, আমাকে শান্তি দান কর এবং আমাকে রিজিক দাও।
১০. এভাবে নামাজ শেষে কিংবা মধ্য (২ রাকাত, ৪ রাকাত) বৈঠক আর শেষ বৈঠকে তাশাহহুদে আল্লাহর প্রশংসা করি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পেশ করে নিজেদের জন্য দোয়া করি, দোয়া মাসুরা পড়ি।
তাশাহহুদ : আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্ সালাওয়াতু, ওয়াত্ তাইয়্যিবাতু। আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আসসালামু আলাইনা ওয়াআলা ইবাদিল্লাহিস্ সালিহিন। আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আননা মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়ারাসুলুহু।
অর্থ : সব সম্মান আল্লাহর জন্য, সব সালাত আল্লাহর জন্য এবং সব ভালো কথা ও কাজসমূহ আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত ও তার বরকত বর্ষিত হোক। আমাদের ওপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা এবং তার রাসুল।
দরূদ : আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়ালা আলি মুহাম্মাদ, কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়ালা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ, আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিও ওয়ালা আলি মুহাম্মাদ, কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়ালা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তার বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন, যেরূপভাবে আপনি হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ করেছিলেন। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত।
দোয়া মাসুরা : আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি- জুলমান কাসিরা, ওয়ালা ইয়াগ ফিরূজ-জুনুবা ইল্লা আন্তা ফাগফিরলি মাগফিরাতাম মিন ইনদিকা ওয়ারহামনি ইন্নাকা আনতাল গাফুরুর রাহিম।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আমার ওপর অত্যাধিক অন্যায় করেছি, গোনাহ করেছি এবং তুমি ব্যতীত পাপ ক্ষমা করার কেউ নেই। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। ক্ষমা একমাত্র তোমার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আমার প্রতি রহম কর। নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল দয়ালু।
১১. দুই দিকে (কাঁধের দিকে) সালাম দিয়ে আমরা নামাজ শেষ করি।
১২. নামাজ শেষে মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করি।