রমজান মাসে কোরআন তেলাওয়াতে সতর্ক থাকা

  • হুমায়ুন কবীর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত অনেক সওয়াবের আমল, ছবি : সংগৃহীত

পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত অনেক সওয়াবের আমল, ছবি : সংগৃহীত

পবিত্র রমজান মাস প্রায় চলে এসেছে। রমজান মাস সবর ও সংযমের মাস, ইবাদত-বন্দেগির মাস; কোরআন মাজিদ নাজিলের মাস। এ মাস বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা ও তেলাওয়াত শোনার মাস। রমজান মাসে মুমিন-মুসলমানরা অন্য মাসের তুলনায় বেশি ইবাদত-বন্দেগি করেন। অনেক বেশি নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকারে সময় কাটান। তাই পবিত্র রমজানকে বলা হয়- ইবাদতের বসন্তকাল।

রমজানের ফজিলত সম্পর্কে কোরআন মাজিদে অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে বহু ফজিলতের কথা উল্লেখ আছে। সেসব আয়াত ও হাদিস পড়ে এবং শুনে আমরা ইবাদত-বন্দেগির প্রতি আকৃষ্ট হই, বেশি বেশি ইবাদতে সময় কাটাই। কিন্তু আমাদের অসচেতনায় কিছু ভুল-ত্রুটির কারণে ইবাদতগুলো সুন্দর হয় না। তেমন কিছু বিষয় হলো-

বিজ্ঞাপন

কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে রমজানে কোরআনের সঙ্গে আমাদের আলাদা একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিয়মিত তেলাওয়াত করা, ঘরের সবাইকে তেলাওয়াতের প্রতি তাগিদ দেওয়া, রাতে তারাবির নামাজে তেলাওয়াত করা ও শোনা আমাদের সাধারণত হয়েই থাকে। তবে এক্ষেত্রে একটা ভুল হয়, সেটা হলো বেশি তেলাওয়াত করতে গিয়ে দ্রুত তেলাওয়াত করা। দ্রুততার কারণে মাঝে-মধ্যে আমাদের উচ্চারণ সুন্দর হয় না, অক্ষর ও শব্দের উচ্চারণ অশুদ্ধ হয়ে যায়, কখনও অস্পষ্ট হয়ে যায়- যা মোটেই কাম্য নয়।

অনেক মসজিদে তারাবির নামাজেও দেখা যায়, দ্রুত তেলাওয়াত করতে। দ্রুততার কারণে কোরআন মাজিদের হক আদায় হয় না। কখনও কখনও তো নামাজ ফাসেদ হওয়ার আশঙ্কা হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

কোরআন কীভাবে তেলাওয়াত করতে হবে, তার নির্দেশনা আল্লাহতায়ালা কোরআনে আমাদেরকে দিয়েছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে সেই তেলাওয়াতের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘কোরআন তেলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে, সুস্পষ্টভাবে।’ -সুরা মুযযাম্মিল : ০৪

হজরত আনাস (রা.) কে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোরআন তেলাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘নবী কারিম (সা.) শব্দগুলোকে টেনে টেনে পড়তেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে বললেন যে, তিনি আল্লাহ, রাহমান এবং রাহিম শব্দকে টেনে পড়তেন।’ -সহিহ বোখারি : ৫০৪৬

হজরত উম্মে সালামা (রা.) কেও একই প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে তিনি বলেন, ‘নবী কারিম (সা.) প্রতিটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন এবং প্রতি আয়াতের পরে থামতেন। তিনি আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন বলে থামতেন। তারপর আর রাহমানির রাহিম বলে থামতেন। তারপর মালিকি ইয়াওমিদ্দিন বলে থামতেন।’ –সুনানে আবু দাউদ : ১৪৬৬

দ্রুত কোরআন তেলাওয়াতের বিষয়ে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। দ্রুত তেলাওয়াত করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমরা কোরআন তেলাওয়াত করছিলাম এমন সময় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এলেন। তখন আমাদের সঙ্গে কিছু গ্রাম্য মানুষ ছিলো, কিছু অনারব মানুষও ছিলো। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমরা কোরআন পড়ো, তোমরা প্রত্যেকেই উত্তম মানুষ। আর অচিরেই এমন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যারা কোরআনকে সোজা করবে, যেভাবে তীর সোজা করা হয়। (তারা তাজবিদ নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করবে।) আর তারা কোরআন পাঠে খুব তাড়াহুড়া করবে, অপেক্ষা করে আস্তে ধীরে তেলাওয়াত করবে না।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৮৩০

প্রায় একই ধরণের হাদিস সাহাবি হজরত সাহাল (রা.) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করছিলাম এমন সময় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এলেন। তিনি বললেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর কিতাব একটাই। আর তোমাদের কেউ লাল, কেউ সাদা আবার কেউ কালো। (তোমরা ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ ও ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ।) তোমরা ওই সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের পূর্বে কোরআন পড়ো, যারা কোরআন সোজা করবে যেভাবে তীর সোজা করা হয়। আর তারা কোরআন পাঠে খুব তাড়াহুড়া করবে, অপেক্ষা করে আস্তে ধীরে তেলাওয়াত করবে না।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৮৩১

কোরআন ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করা উত্তম, ছবি : সংগৃহীত

 

আমরা কোরআন মাজিদ দ্রুত তেলাওয়াত করি। অন্যান্য কিছু আমলও খু্ব দ্রুত করার চেষ্টা করি। আমরা মনে করি, দ্রুত তেলাওয়াত করে যত বেশি পড়তে পারব, তাড়াহুড়া করে যত বেশি আমল করতে পারব, ততো বেশি সওয়াবের অধিকারী হব। এবং কেয়ামতের দিন বেশি হওয়াটা আমাদের জন্য লাভজনক হবে। মনে রাখতে হবে, কেয়ামতের দিন আমল গণনা করা হবে না। কে কত পারা তেলাওয়াত করল, কত খতম শেষ করল বা কত রাকাত নামাজ পড়ল- এসব দেখা হবে না। বরং মিজানের পাল্লায় আমলগুলো পরিমাপ করা হবে। যেমন কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সঠিকভাবে আমলগুলো ওজন করা হবে, সুতরাং যাদের পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম ও কৃতকার্য হবে।’ -সুরা আরাফ : ০৮

এ জন্য তাড়াহুড়া করে আমলের সংখ্যা না বাড়িয়ে আস্তে-ধীরে আমল করে আমলের গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যার পাল্লাসমূহ ভারী হবে, সে সন্তোষজনক জীবনে থাকবে।’ -সুরা কারিয়া : ৬-৭

আমাদের আমলের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন, না ওজন বাড়ানো প্রয়োজন- এ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) অনেক সুন্দর বলেছেন- ‘আমলের ওজন ইখলাস তথা আন্তরিকতা ও সুন্নতের সঙ্গে সামঞ্জস্যতার কারণে বেড়ে যায়। যার আমল আন্তরিকতাপূর্ণ ও সুন্নতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সংখ্যায় কম হলেও তার আমলের ওজন বেশি হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সংখ্যায় অনেক আমল করবে, নামাজ, রোজা, দান-সদকা, হজ-ওমরা অনেক করবে, কিন্তু আন্তরিকতা ও সুন্নতের সঙ্গে সামঞ্জস্য কম হবে, তার আমলের ওজন কম হবে। মানুষ আমলের যে পুঁজি নিয়ে আল্লাহর আদালতে আসবে তা ভারী না হালকা, তার ভিত্তিতে সেখানে ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে।’ -মাজমুল ফাতাওয়া লিশায়খিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া : ১০/৭৩৫–৭৩৬

সুতরাং কোরআন তেলাওয়াতসহ সকল প্রকার আমলের ব্যাপারে আমাদের আন্তরিক হতে হবে। আল্লাহর নির্দেশনা ও হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী আমল করতে হবে।

ইমাম গাজালি (রহ.) বলেছেন, ‘অনেক মানুষ এমন রয়েছে, তারা কোরআন তেলাওয়াত করে। কিন্তু কোরআন তাদেরকে অভিশাপ দিতে থাকে।’ -এহইয়া উলুমিদ্দীন : ১/৩২৪

এর ব্যাখ্যায় আলেমরা বলেছেন, যারা দ্রুত তেলাওয়াত করে, অক্ষরগুলো স্পষ্টভাবে পড়ে না, উচ্চারণ সুন্দর করে না কোরআন তাদেরকে অভিশাপ দেয়।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি চায় সে আল্লাহ ও তার রাসুলকে বেশি ভালোবাসুক এবং বেশি ভালোবাসা পাক, সে যেন কোরআন মাজিদ দেখে তেলাওয়াত করে।’ -বায়হাকি, শোয়াবুল ঈমান : ২২১৯

অন্য হাদিসে হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কোরআন পাঠ কর। কেননা, কেয়ামতের দিন কোরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে।’ -সহিহ মুসলিম : ১৯১

সুতরাং আমাদের উচিত, রমজানে এবং রমজানের বাইরে, যখনই আমরা কোরআন তেলাওয়াত করব- এমনভাবে তেলাওয়াত করব, যে তেলাওয়াত আমাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুলের নৈকট্য লাভের মাধ্যম হবে। ভালোবাসা পাওয়ার উপায় হবে। মিজানের পাল্লা ভারী হওয়ার কারণ হবে। যে তেলাওয়াত আমাদের জন্য সুপারিশকারী হবে। আমাদের তেলাওয়াত করা ও তেলাওয়াত শোনা যেন কোনোভাবেই অভিশাপ না হয়, সে ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।