ফিতরা কি টাকা দিয়ে আদায় করা যাবে?

  • মাওলানা ফখরুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঈদুল ফিতর একটি তাৎপর্যময় অঙ্গ হলো ফিতরা, ছবি : সংগৃহীত

ঈদুল ফিতর একটি তাৎপর্যময় অঙ্গ হলো ফিতরা, ছবি : সংগৃহীত

আমাদের দেশে প্রায় সবাই টাকা দিয়ে সদকাতুল ফিতর তথা ফিতরা আদায় করে থাকেন। যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সবাই এভাবেই ফিতরা আদায় করে আসছেন। কিন্তু ইদানিং কেউ কেউ বলছেন, টাকা দিয়ে ফিতরা প্রদান করলে; তা আদায় হবে না। বরং খেজুর, যব, আটা ইত্যাদি খাবার দিতে হবে। কারণ, হাদিসে পাঁচটি জিনিস দিয়ে ফিতরা আদায়ের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো- খেজুর, যব, কিসমিস, পনির ও আটা।

এ সম্পর্কে হাদিস এসেছে, হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ফিতরা হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা পরিমাণ আদায় করা আবশ্যক করেছেন এবং লোকজনের ঈদের নামাজে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। -সহিহ বোখারি : ১৫০৬

বিজ্ঞাপন

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ফিতরা হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা পরিমাণ আর গম আধা সা পরিমাণ আদায় করা আবশ্যক করেছেন। -সুনানে আবু দাউদ : ১৬২২

বর্ণিত হাদিসে খেজুর, যব ইত্যাদি দ্বারা ফিতরা আদায় করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু টাকা কিংবা মূল্য দিয়ে তো ফিতরা আদায় করার কথা কোথাও বলা হয়নি; অথচ নবীজীর সময়ে দিরহাম ও দিনারের প্রচলন ছিল।

বিজ্ঞাপন

যদি মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা বৈধ হত, তাহলে নবীজী (সা.) খেজুর, যব ইত্যাদির সঙ্গে এত দিরহাম কিংবা এত দিনার হবে, এটাও বলে দিতেন।

মোটাদাগে এই হচ্ছে তাদের বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? বাস্তবেই কি টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় হবে না?

না, বাস্তবতা এমন নয়। দেখুন, হাদিসে পাঁচটি বস্তু দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা বলা হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু হাদিসের উদ্দেশ্য কি শুধু এই পাঁচটি বস্তুই? নাকি ওই পাঁচটি বস্তু কিংবা এর সমমূল্য উদ্দেশ্য?

বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। হাদিসে উটের জাকাত উট দিয়ে, বকরির জাকাত বকরি দিয়ে, শস্যের জাকাত শস্য দিয়ে ও পণ্যের জাকাত পণ্য দিয়ে দেওয়ার কথা এসেছে।

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-এর হাদিসে বিষয়টি সস্পষ্টভাবে ফুটে ‍উঠেছে। নবীজী (সা.) তাকে ইয়েমেনে প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন, ‘ফসল থেকে ফসল, বকরিপাল থেকে ছাগল, উটপাল থেকে উট, গরুর পাল থেকে গরু জাকাত হিসেবে গ্রহণ করবে।’ -সুনানে আবু দাউদ : ১৫৯৯

হজরত মুয়াজ (রা.) কি করলেন? তিনি সেখানে গিয়ে ইয়েমেনবাসীদের বললেন, তোমরা যব ও ভুট্টার পরিবর্তে চাদর বা পরিধেয় বস্ত্র আমার কাছে জাকাতস্বরূপ নিয়ে আসো। ওটা তোমাদের পক্ষেও সহজ এবং মদিনায় নবীজীর সাহাবিদের জন্যেও উত্তম। -সহিহ বোখারি : ২৮০

দেখুন, নবীজীর স্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও হজরত মুয়াজ (রা.) যব এবং ভুট্টার পরিবর্তে চাদর এবং পরিধেয় বস্ত্র গ্রহণ করলেন। তাহলে কি হজরত মুয়াজ (রা.) নবীজীর নির্দেশ অমান্য করলেন? না, তিনি নবীজীর নির্দেশ অমান্য করেননি। তাহলে?

যেকোনো বিবেকবান মানুষ এটাই বলবে যে, তিনি নবীজীর নির্দেশ অমান্য করেননি। বরং তিনি ভালো করেই বুঝেছেন নবীজীর নির্দেশের বাহ্যিক অর্থ অর্থাৎ হুবহু উট, বকরি ও শস্য গ্রহণ করাই এখানে তার উদ্দেশ্য নয়। বরং নবীজীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওই সব বস্তু কিংবা এর সমমূল্য।

ফিতরার ক্ষেত্রে একই রকম ঘটেছে। অর্থাৎ নবীজী (সা.) ফিতরা আদায়ের জন্য নির্ধারিত কয়েকটি বস্তুর নাম বলেছেন। কিন্তু এর উদ্দেশ্য কখনোই এই নয় যে, হুবহু এই বস্তুগুলোই দিতে হবে; এগুলোর মূল্য কিংবা সমমূল্যের বস্তু দিলে আদায় হবে না। বিষয়টি এমন নয়। বরং নবীজীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, হুবহু ওই বস্তুগুলো দিলে যেমন ফিতরা আদায় হবে, ওইগুলোর মূল্য হিসেব করে আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে।

সাহাবায়ে কেরাম রা. সাদাকাতুল ফিতর সংক্রান্ত নির্দেশনাটি এভাবেই বুঝেছেন। এ কারণেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে হাদিসে বর্ণিত খাদ্যশস্য দিয়ে ফিতরা আদায়ের কথা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায়ের প্রমাণও তাদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য (গম) দ্বারা অথবা এক সা যব অথবা এক সা খেজুর, কিংবা এক সা পনির বা এক সা কিসমিস দ্বারা।’ -সহিহ বোখারি : ১৪৭২

এই বর্ণনায় হাদিসে বর্ণিত বস্তুগুলো দিয়ে ফিতরা আদায়ের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

অপরদিকে হজরত আবু ইসহাক আস সাবিয়ি (রহ.)-এর বর্ণনায় সাহাবায়ে কেরামের মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায়ের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

তিনি বলেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে ফিতরা আদায় করতেন খাবার সমমূল্যের দিরহাম দিয়ে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১০৪৭২

এই বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) দিরহাম (টাকা) দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম জাকাতের হাদিসকে যেমন বাহ্যিক অর্থে প্রয়োগ না করে নবীজীর মূল উদ্দেশ্য বুঝে নির্ধারিত বস্তুর পাশাপাশি মূল্য ধরে জাকাত দিতেন, তেমনিভাবে ফিতরার ক্ষেত্রেও নবীজীর মূল উদ্দেশ্য বুঝে হাদিসে বর্ণিত বস্তু দিয়ে যেমন ফিতরা আদায় করতেন, এগুলোর মূল্য ‍দিয়েও ফিতরা আদায় করতেন।

তাবেয়িনদের সময়ে তো টাকা দিয়ে আদায় করার বিষয়টি এক পর্যায়ে ব্যক্তি বিশেষে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবেই ফিতরা মূল্য দিয়ে আদায় করার নিয়ম চালু হয়।

এ সম্পর্কে কুররা ইবনে খালিদ বলেন, ‘আমাদের নিকট খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত উমর বিন আব্দুল আযিযের পক্ষ থেকে পত্র আসল যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন আধা সা (গম) অথবা তার মূল্য আধা দিরহাম ফিতরা হিসেবে প্রদান করে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৫০৮

প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করতে কোনো সমস্যা নেই।’ -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৫০৮

লক্ষণীয় বিষয় হলো, খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযিয রাষ্ট্রীয় নির্দেশ জারি করলেন এমন এক সময়, যখন অসংখ্য তাবিয়ি জীবিত। কিন্তু একজনও প্রতিবাদ করলেন না যে না, মূল্য দিয়ে তো ফিতরা আদায় হয় না সুতরাং এটা শরিয়তবিরোধী। কেউ কিন্তু এমন কথা বলেননি।

এর মানে কি এই নয় যে, বিষয়টি ওই সময় সবার জানা ছিল এবং সবার কাছেই বিষয়টি স্বীকৃত ছিল যে, হাদিসে বর্ণিত খাদ্য দিয়ে যেমন ফিতরা আদায় করা যায়, তেমনিভাবে টাকা দিয়েও আাদায় করা যায়?

বস্তুত টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করা এটি আমলে মুতাওয়ারিছ তথা সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িনদের কর্মপরম্পরা দ্বারা প্রমাণিত বিষয়। অর্থাৎ সাহাবা এবং তাবেয়িগণ হাদিসে বর্ণিত খাদ্যশস্যের দ্বারা যেমন ফিতরা আদায় করেছেন, তেমনিভাবে এগুলোর মূল্য দিয়েও আদায় করেছেন। অথচ নবীজীর হাদিস তাদের সামনেই ছিল। এর মানে তো এটাই যে, তারা নবীজীর কথার অর্থ এটাই বুঝেছেন যে, শুধু এই খাদ্যশস্যগুলোই উদ্দেশ্য নয়; বরং এগুলো দিলে যেমন ফিতরা আদায় হবে তেমনিভাবে এগুলোর মূল্য দিলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।

আরেকটি বিষয়, ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, জাকাতের ক্ষেত্রে নবীজীর সুস্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও হজরত মুয়াজ (রা.) মূল্যের প্রতি লক্ষ করে যব এবং ভুট্টার পরিবর্তে চাদর এবং পরিধেয় বস্ত্র গ্রহণ করে বলেছিলেন, ‘ওটা তোমাদের পক্ষেও সহজ এবং মদিনায় নবীজীর সাহাবিদের জন্যেও উত্তম।’

একইকথা সদকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ নবীজীর সময়ে খাদ্যশস্য মদিনাবাসীর জন্য উপযোগী ছিল এবং এগুলো তাদের খুব প্রয়োজন ছিল তাই তখন খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন; কিন্তু এখন মানুষের জন্য টাকা বেশি উপযোগী, বেশি প্রয়োজনীয়। সুতরাং এখন ফিতরা হিসেবে টাকা দেওয়াই বেশি উত্তম হবে। এটি দরিদ্রদের জন্যও বেশি উপকারী হবে।

সুতারাং এই প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই যে, খাদ্যশস্যের মতো টাকা দিয়েও যদি ফিতরা আদায় করা বৈধ হয়, তাহলে নবীজী (সা.) কেন দিরহাম দিনারের কথা বললেন না? তখন তো দিরহাম দিনার ছিল।