গণ-ইফতার আয়োজনের সওয়াব
রোজা আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। রোজা রেখে বান্দা প্রকাশ করে যে আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টির জন্য বান্দা পানাহারের মতো মৌলিক প্রয়োজনও পরিহার করে। রোজার সূচনা হয় সুবহে সাদিক হওয়ার সময় এবং শেষ হয় সূর্যাস্তের সময়।
রোজার শুরুভাগে সাহরি খাওয়া সুন্নত। যেন রোজা রাখা সহজ হয়। শেষভাগে ইফতার করা ওয়াজিব। বিলম্বে ইফতার করা মাকরুহ।
যদি সারা দিন ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করা ইবাদত হয়, তবে সূর্যাস্তের পর দ্রুত ইফতার করাও ইবাদত। কেননা উভয়টি আল্লাহর নির্দেশ। দ্রুত ইফতার করার অর্থ হলো আল্লাহর সামনে এ কথা প্রকাশ করা যে আমরা আপনার রিজিক থেকে অমুখাপেক্ষী নই, বরং আমরা খাবারের একেকটি দানা ও পানির প্রতিটি ফোঁটার প্রতি মুখাপেক্ষী। যখন আপনি থামতে বলেছেন, তখন থেমে গেছি।
আর যখনই অনুমতি পেয়েছি আপনার নিয়ামতের প্রতি ঝুঁকেছি। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে দ্রুত ইফতারকারী আমার কাছে অধিক প্রিয়।’ -সুনানে তিরমিজি : ৭০০
যেহেতু ইফতারের মাধ্যমে রোজা পূর্ণতা পায়, তাই ইফতারও ইবাদত। ইফতার ইবাদত বলেই হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইফতারের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তার শিষ্টাচার বর্ণনা করেছেন। যেমন- ইফতারের আগে দোয়া পাঠ করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইফতারের আগে দোয়া করতেন, ‘জাহাবাল জামাউ, ওয়াবতাল্লাতিল উরুকু, ওয়া সাবাতাল আজরু, ইনশাআল্লাহু।’ র্থ : পিপাসা দূর হয়েছে, শিরা-উপশিরা সিক্ত হয়েছে এবং প্রতিদানও নির্ধারিত হয়েছে, ইনশাআল্লাহ!’ -সুনানে আবু দাউদ : ২৩৫৭
একইভাবে কোনো জিনিস দ্বারা ইফতার করা হবে তার বর্ণনাও হাদিসে এসেছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ রোজা রাখলে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে। আর খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করে। কেননা পানি পবিত্র। -সুনানে আবু দাউদ : ২৩৫৫
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মাগরিবের নামাজের আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। আর কিছু না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করতেন। -সুনানে আবু দাউদ : ২৩৫৪
ইবাদতে সাহায্য করা পুণ্যের কাজ এবং তা মুসলমানের কাছে প্রত্যাশিত। তাই অন্যকে ইফতার করালে সওয়াব মেলে। নবী কারিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় সে রোজাদারের অনুরূপ সওয়াব পায়। রোজাদারের সওয়াব থেকে কোনো কিছু হ্রাস করা হয় না। -সুনানে আবু দাউদ : ৮০৭
অন্যকে ইফতার করানোয় বিশেষ সওয়াব থাকায় মুসলিম সমাজে ইফতার মাহফিল ও গণ-ইফতারের প্রচলন রয়েছে। এটা প্রশংসনীয়। তবে ইফতার ইবাদত হওয়ায় এর আয়োজনে কিছু বিষয় লক্ষ রাখা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে, ইফতার করা ও করানো ইবাদত। আর ইবাদতের যোগ্য ব্যক্তি কেবল মুসলমান। তাই ইফতার আয়োজনে মুসলমানদের প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক।
সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি, দ্বিনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া এবং বিভ্রান্তি দূর করতে অমুসলিমদেরও ইফতার আয়োজনে দাওয়াত দেওয়া যেতে পারে, এতে দোষের কিছু নেই। কেননা ইসলামের প্রাথমিক যুগে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বনি হাশিমের লোকদের আমন্ত্রণ করে খাওয়ান এবং তাদের সামনে ইসলামের বাণী তুলে ধরেন। তবে অমুসলিম নেতাদের ইফতার মাহফিলে নিয়ে আসা এবং সব মনোযোগ তার প্রতি আবদ্ধ রাখা ইফতারের ধর্মীয় গাম্ভীর্য ও মর্যাদার পরিপন্থী। মূলত এমন আয়োজনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বাইরে কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য থাকে না।
রোজাদারকে ইফতার করানো ইবাদত। এর কারণ হিসেবে প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, এর দ্বারা মানুষের প্রয়োজন পূরণ হয় এবং ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায়। তাই ইফতার আয়োজনে অসহায় ও স্বল্প সামর্থ্যের মানুষদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। অন্তত এমন যেন না হয়, সেখানে সাধারণ রোজাদারের কোনো সুযোগ নেই। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন ওলিমার খাবারকে নিকৃষ্টতর বলেছেন, যেখানে দরিদ্র লোকদের পরিবর্তে শুধু ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়। -সহিহ বোখারি : ৫১৭৭
ইসলাম চায় গরিব ও অসহায় মানুষ সামাজিক আয়োজনগুলোতে অংশ নিক। এ জন্য ঈদুল ফিতরের সঙ্গে সঙ্গে সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে, ঈদুল আজহার সময় কোরবানির গোশত বিতরণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। মূলত কথা হলো, গণইফতারের আয়োজন এমনভাবে ও এমন স্থানে করা উচিত, যাতে অধিকসংখ্যক অসহায় মানুষ তাতে অংশ নিতে পারে। কোরবানির গোশতের সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, তাদের অংশ যেন এক-তৃতীয়াংশের কম না হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সর্বাবস্থায় ইফতার আয়োজনে ইবাদতের আবহ রক্ষা করা। যেমন- ইফতারের কিছু সময় আগে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে তাসবিহ ও জিকিরে মশগুল থাকবে, গুরুত্বের সঙ্গে দরুদ পাঠ করবে, কোরআন তেলাওয়াত করবে অথবা সেখানে ধর্মীয় আলোচনা হবে, বিশেষত ইফতারের আগে যেন দোয়া করা হয়। কেননা ইফতারের সময় দোয়া কবুল করা হয়। সর্বোপরি সব মনোযোগ থাকবে মহান আল্লাহর প্রতি। যেন ইফতার আয়োজন পরকালীন মুক্তির উসিলা হয়।