২০২৫ সালের পবিত্র হজপালনের লক্ষ্যে নিবন্ধন শুরু হলেও প্রত্যাশিত সাড়া মিলছে না। ইতোমধ্যে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা উল্লেখ করে সরকারি ও বেসরকারিভাবে একাধিক হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে খরচ খুব একটা কমানো হয়নি। এবারও পাঁচ লাখ টাকার নিচে হজে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
হজ কার্যক্রম শুরুর দুই মাস পার হয়ে গেলেও রোববার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রাথমিক নিবন্ধন করেছে মাত্র ১৩ হাজার ৯৬১ জন হজযাত্রী। যদিও সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী হজের কোটা রয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি দুই মাধ্যমেই হজ নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে হজে যেতে হলে প্রথম ধাপে ৩০ হাজার টাকা ফি পরিশোধ করে প্রাকনিবন্ধন করতে হয়। এরপর ৩ লাখ টাকা দিয়ে প্রাথমিক নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হচ্ছে।
১ সেপ্টেম্বর থেকে হজের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। এবার সরকারিভাবে হজের কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ১০ হাজার ১৯৮ জন। প্রয়োজনে এই সংখ্যা বাড়তে পারে। আর বেসরকারিভাবে গাইডসহ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার জনের। কিন্তু নিবন্ধনের প্রায় আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে নিবন্ধন করেছেন ৩ হাজার ২৫২ জন। আর বেসরকারিভাবে নিবন্ধন করেছেন ১০ হাজার ৭০৯ জন। এখনো প্রায় ৮৬ শতাংশের মতো কোটা শূন্য রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হজ একটি ফরজ ইবাদত হলেও সেটি এখন ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্র হয়েও হজ ব্যবস্থাপনায় সরকারের কোনো সহায়তা নেই। উলটো অতিরিক্ত উড়োজাহাজ ভাড়া নির্ধারণ করে হজ প্যাকেজের খরচ বাড়ানো হয়। এতে একদিকে হজের খরচ বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইচ্ছে থাকলেও অর্থের অভাবে হজপালন করতে পারেন না। এতে মুসলমানদের হজপালন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফলে কয়েক বছর ধরে হজের কোটা পূরণ হচ্ছে না।
এক্ষেত্রে সরকার চাইলে সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করে হজযাত্রীদের জন্য সব এয়ারলাইন্স সংস্থা উন্মুক্ত করে দিতে পারে। এতে যাত্রী বহনে প্রতিযোগিতা চলে আসবে। বহনকারী সংস্থা বেশি হলে ভাড়া এমনিতেই কমে আসবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা গত ৩০ অক্টোবর হজ প্যাকেজ ঘোষণায় হজের খরচে যে হারে কমিয়েছেন, তাতে হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ আসবে বলে মনে হয় না।
এখনো হজের ক্ষেত্রে সৌদি আরবে তিন লাখ টাকা এবং উড়োজাহাজ ভাড়া এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা রয়ে গেছে। হজ গাইড ও আনুষঙ্গিকসহ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়। তার ওপর হজের কোরবানি, খাবারসহ আনুমানিক খরচ ৫০ হাজার টাকা।
অর্থাৎ নিজস্ব কেনাকাটা বাদ দিলেও হজ করতে ন্যূনতম পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হবে। বাংলাদেশে থেকে হজ করতে আগ্রহী অনেকের পক্ষে এত টাকা ব্যয় করা কঠিন।
করোনা মহামারির আগে ২০১৯ সালে তিন লাখ থেকে সোয়া তিন লাখ টাকার মধ্যে হজ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে তিন খাতে হজের ব্যয় বেড়ে গেছে বলে মনে করি। ১. বাংলাদেশি টাকা অনুপাতে ডলারের দাম বৃদ্ধি। ২. হজ ফ্লাইটের ভাড়া বৃদ্ধি। ৩. সৌদি আরবে হজের বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি।
পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরসহ বাংলাদেশ আমলের গত ৫০ বছর তথা ৭৩ বছরের ইতিহাসে হজ করতে চরম আর্থিক প্রতিকূলতা দেখা দিচ্ছে। এই ৭৩ বছর কোটা অনুপাতে হজযাত্রীর সংখ্যা অত্যধিক ছিল। হজযাত্রীরা তালিকাভুক্ত হতে তৎপর। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হোক কিংবা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হোক গত হজ তথা ২০২৩ সালের হজে কয়েক বার করে সময় বাড়ানোর পরও চার হাজার ৫০০ কোটা খালি যায়। গত বছর হজে বাংলাদেশের কোটার তিন ভাগের এক ভাগ তথা ৪৪ হাজারের মতো কোটা খালি যায়।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে হজ হবে ২০২৫ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। যারা হজে গমন করবে তারা অনেক আগে থেকেই আর্থিকসহ মনমানসিকতায় প্রস্তুত থাকবে। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চূড়ান্ত নিবন্ধনে হজযাত্রীর কোটা তিন ভাগের এক ভাগও পূর্ণ হবে কি না সন্দেহ!
কাজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হজ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে অতি তৎপর হতে হবে। উড়োজাহাজ ভাড়া কমিয়ে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকায় আনা যায় কি না ভেবে দেখা দরকার।
সৌদি আরবে হজের বিভিন্ন খাতে খরচ আরো কমানোর জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। তা না হলে এত ব্যয়ে আমাদের বাংলাদেশ থেকে হজের কোটার তিন ভাগের এক ভাগও যদি পূর্ণ না হয় তাহলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ওপর আঘাত আসতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারির পর থেকে সৌদি সরকার উমরা ব্যবস্থাপনাকে অতি সহজ করে দিয়েছে। উমরা ভিসার মেয়াদ এক মাসের স্থলে তিন মাস করা হয়েছে। এজেন্সি ছাড়া কারো সহযোগিতা না নিয়ে উমরা করা যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ উমরাপালনে গমন করছে। ১৫ দিনে মাত্র এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকার মধ্যে যাতায়াত, উড়োজাহাজ ভাড়া, পবিত্র মক্কা-মদিনায় অবস্থান, থাকা-খাওয়াসহ উমরা করা যাচ্ছে। এতে উমরাকারী ইহরাম পরিধান, খানায়ে কাবা তাওয়াফ, সাফা-মারওয়া সাঈ, আরাফাত-মিনা-মুজদালিফা ঘুরে আসছে এবং জিয়ারতের উদ্দেশে পবিত্র মক্কা-মদিনায় গমন করছে।
উমরা ব্যবস্থাপনা অতি সহজ হওয়ায় দুই সপ্তাহের প্যাকেজে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকার মধ্যে করতে পারায় মনে হয় তা হজের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
হজ ফরজ ইবাদত। উমরা করলে হজ আদায় হয় না। কাজেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ, হজ প্যাকেজ ২০২৫ পুনর্বিবেচনা করুন এবং হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।