আল্লাহর কাছে যে বেশি প্রিয়
কোরআন মাজিদের সুরা আল-হুজরাতে আমরা পড়ি, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।’
তাকওয়া ও পরহেজগারী একটি শক্তি, যা প্রকৃতই অতুলনীয়। আরবি ভাষায় ‘তাকওয়া’ শব্দের অর্থ বেঁধে রাখা, পরিহার করা এবং দূরে থাকা।
পবিত্র কোরআনের ব্যবহারিক ভাষায় তাকওয়া বলতে অন্তরের সেই অবস্থা ও পরিবেশকে বুঝায়, যা আল্লাহতায়ালাকে সর্বদা হাজির-নাজির হওয়ার বিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং অন্তরে ভালো ও মন্দের তারতম্য নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভালোর প্রতি আকর্ষণ বর্ধিত করে এবং মন্দের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং ঘৃণাকে প্রকট করে তোলে।
অন্য কথায় বলা যায়, তাকওয়া হচ্ছে- অন্তরের অনুভূতি ও অন্বেষার নাম। যার প্রতিফলনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক কাজ করার তীব্র বাসনা সৃষ্টি হয় এবং একই সঙ্গে বিরুদ্ধবাদিতার প্রতি অবজ্ঞা ভাবের উদয় হয়।
সুরা হুজরাতে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুরায় বর্ণিত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করলে সমাজের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হয়। সমাজ থেকে পরস্পরে শত্রুতা, বিদ্বেষ, অমূলক সন্দেহ ও বিভেদ দূরীভূত হয়।
এই সুরার ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।’
আলেমরা বলেন, পৃথিবীর সব মানুষের চেহারা ও গায়ের রঙ যদি একই রকম হতো; তাহলে তাদেরকে চেনা ও খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে যেত। পৃথিবীর মানুষের প্রতি আল্লাহর বড় একটি নেয়ামত হলো, তিনি মানুষকে বিভিন্ন বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন এবং তাদেরকে নানা ধরনের ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা চেহারা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এমনকি জমজ সন্তানও সবদিক দিয়ে পরস্পরের সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। দুই জমজ ভাইকে অপরিচিত মানুষের কাছে একই রকম মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের অভিভাবক বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন তাদেরকে ঠিকই আলাদা করে চিনতে পারে।
বর্ণিত আয়াতে শারিরীক ও বর্ণগত দিক দিয়ে মানুষে মানুষে পার্থক্যের বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, এই পার্থক্যের মূল লক্ষ্য হচ্ছে- মানুষ যেন একে অপরকে চিনতে পারে এবং সামাজিক সম্পর্কসহ অন্যান্য বিষয়াদিতে পরস্পরের সঙ্গে মিশে না যায়।
অবশ্য কোনো কোনো বর্ণ বা জাতির লোকজন এই পার্থক্যের বিষয়টিকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে জাহির করতে চায়। অথচ এই আয়াতে বলা হচ্ছে, তোমরা সবাই এক পিতা ও মাতা থেকে এসেছ এবং তোমাদের সবার উৎস হচ্ছেন বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)। কাজেই বিষয়টি নিয়ে গর্ব করার কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র যে যত বেশি মুত্তাকি বা পরহেজগার, আল্লাহতায়ালার কাছে তার মর্যাদা তত বেশি।
অনুরূপভাবে বিদায় হজের ভাষণে নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘হে লোকজন! সাবধান তোমাদের আল্লাহ একজন। কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের, কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, কোনো কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের ও কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই আল্লাহভীতি ছাড়া। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। আমি কি তোমাদেরকে (আল্লাহর বাণী) পৌঁছেছি? তারা (সাহাবিরা) বলল, আল্লাহর রাসুল পৌঁছেছেন। তিনি বললেন, তাহলে যারা এখানে উপস্থিত আছে, তারা যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে এ বাণী পৌঁছে দেয়।’ -মুসনাদে আহমাদ : ৫/৪১১
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তোমাদের বংশ ও আভিজাত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। তোমাদের মধ্যে যে বেশি আল্লাহভীরু সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী।’ -ইবনে জারির : ৩১৭৭২
আরেক হাদিসের ভাষা হচ্ছে, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন।’ -সহিহ মুসলিম : ২৫৬৪
কোরআন-হাদিসের স্পষ্ট কথা, কোনো মানুষের কেবল কুলমান ও বংশের ভিত্তিতে অহংকার করার কোনো অধিকার নেই। কারণ, সবার বংশ হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে গিয়ে মিলে যায়।
তার পরও বিভিন্ন জাতি, বংশ ও গোত্রের বণ্টন কেবল পরস্পর পরিচিতির জন্য। একে অপরের ওপর নিজের আভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের জন্য নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আজকাল বংশ ও আভিজাত্যকেই শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি বানিয়ে নেওয়া হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইসলাম এটাকে মূর্খতা বলে আখ্যায়িত করেছে।