মর্যাদার লোভও পাপের কারণ
মর্যাদার প্রতি লোভের একটি দিক হলো- মানুষের প্রশংসা শুনতে চাওয়া। এটা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। অন্যরা যখন প্রশংসা করে তা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সংকট হয় তখন যখন কেউ কোনো কাজ না করেও সে জন্য প্রশংসা শুনতে চায় কিংবা কেউ তার প্রশংসা না করলে তাকে নানাভাবে কষ্ট দিতে থাকে।
আল্লাহতায়ালার ঘোষণা এমন, ‘যারা নিজেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে উৎফুল্ল এবং যা তারা করেনি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে ভালোবাসে, তুমি অবশ্যই তাদেরকে ভাববে না যে, তারা আজাব থেকে বেঁচে যাবে। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ -সূরা আলে ইমরান : ১৮৮
মর্যাদার প্রতি লালসা যখন দ্বীনি কোনো বিষয় নিয়ে হয়, কোনো ইবাদত-বন্দেগি করে কেউ যখন মানুষের কাছে মর্যাদা ও শ্রদ্ধার পাত্র হতে চায়, দান-সদকা করে, বারবার হজ-উমরা আদায় করে কিংবা কাড়ি কাড়ি ইলম (জ্ঞান) শিখে কেউ যখন অন্যদের দৃষ্টিতে সম্মানের আসনে বসতে চায়, তার মুক্তির তখন কোনো উপায় থাকে না। কোরআন-হাদিসের ঘোষণা অনুসারে দোজখই তার ঠিকানা!
হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদের বিষয়ে ফয়সালা করা হবে, তাদের একজন শহিদ, একজন আলেম এবং একজন দান-সদকাকারী। শহিদকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হলে তিনি তাকে তার নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্বীকার করবে। এরপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তাতে কী আমল করেছ? সে উত্তর দেবে, আপনার পথে লড়াই করতে করতে আমি শহিদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি বরং লড়াই করেছো- যেন তোমাকে সাহসী বীর যোদ্ধা বলা হয়। এটা তো তোমাকে বলা হয়েছেই। তখন আল্লাহর আদেশে তাকে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে।
এরপর আলেমকে নিয়ে আসা হবে, যে নিজে ইলম শিখেছে, অন্যকে শিখিয়েছে এবং কোরআন তেলাওয়াত করেছে। তিনি তাকে তার নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্বীকার করবে। এরপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তাতে কী আমল করেছ? সে উত্তর দেবে, আমি নিজে ইলম শিখেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং কোরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি ইলম শিখেছ যেন তোমাকে আলেম (আল্লামা) বলা হয়। কোরআন পড়েছো যেন তোমাকে কারি বলা হয়। এগুলো তো বলা হয়েছেই। তখন আল্লাহর আদেশে তাকে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর নিয়ে আসা হবে ওই দান-সদকাকারীকে, যাকে আল্লাহ প্রচুর সম্পদ দান করেছিলেন। তিনি তাকে তার নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্বীকার করবে। এরপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তাতে কী আমল করেছ? সে উত্তর দেবে, আপনি পছন্দ করেন এমন কোনো পথ নেই যেখানে আমি দান করিনি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি বরং দান করেছ যেন তোমাকে দানবীর বলা হয়। এটা তো বলা হয়েছেই। তখন তাকেও আল্লাহর আদেশে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে। -সহিহ মুসলিম : ১৯০৫
এই হচ্ছে লোভ। মোটকথা, অর্থ-সম্পদ নিয়ে হোক, আর সম্মান-মর্যাদা নিয়ে হোক, সব লোভের ক্ষেত্রে সমানভাবে এ কথা প্রযোজ্য- লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
অথচ আল্লাহতায়ালা যেভাবে মানুষের হায়াত-মওত সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা যেমন সুনির্ধারিত, ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষের জন্যেই তার রিজিকও নির্ধারিত। এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই।
এক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নির্ধারিত রিজিক দুনিয়াতে পরিপূর্ণরূপে পাওয়ার আগে কিছুতেই কারও মৃত্যু হবে না।’ তাহলে আর লোভের পেছনে ছোটা কেন? অন্যের সঙ্গে শুধুই সম্মান আর সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা কেন? মুমিন বান্দার উচিত, নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর সিদ্ধান্তের সামনে সঁপে দেওয়া। দুনিয়াতে সহজতার সঙ্গে যতটুকু সম্ভব উপকরণ অবলম্বন করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয় পুরোটাই আল্লাহর হাতে ন্যস্ত করা। আর প্রয়োজন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তাকওয়া ও আল্লাহর ভয়কে অবলম্বন করে চলা।
মনে রাখতে হবে, আল্লাহতায়ালার ঘোষণায় কোনো অস্পষ্টতা নেই, ‘কেউ যদি আল্লাহকে ভয় করে তাহলে তিনি তার জন্যে কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে তিনি এমন স্থান থেকে রিজিক দেবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না।’ -সূরা তালাক : ২-৩
আর মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়ে কোরআনে কারিমের ভাষ্য, ‘যে ব্যক্তি মর্যাদা লাভ করতে চায়, (সে জেনে রাখুক-) সমস্ত মর্যাদা আল্লাহরই হাতে।’ -সূরা ফাতির : ১০
লোভের অবশ্য প্রশংসনীয় কিছু ক্ষেত্রও আছে। যেমন, এক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লোভাতুর ও তৃষ্ণার্ত দুই ব্যক্তি, যারা কখনোই তৃপ্ত হয় না- ইলম অর্জনে যে নিমগ্ন, তার লোভ কখনো শেষ হয় না, দুনিয়া অর্জনে যে লিপ্ত, সেও কখনো তৃপ্ত হয় না।’ -শোয়াবুল ঈমান : ৯৭৯৮
দুনিয়া অর্জনে লোভ যতটা নিন্দনীয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ইলম অর্জনে সে লোভ ঠিক ততটাই প্রশংসনীয়। কল্যাণের এমন যত খাত, লোভ কাঙ্খিত ওই সব ক্ষেত্রেই।