নিজের পেশায় সন্তুষ্ট থাকা
দুনিয়ায় জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। এতে যা উপার্জন হয় তা দ্বারা প্রত্যেকে তার নিজের ও পোষ্যবর্গের প্রয়োজন মেটায়। সম্মানজনকভাবে প্রয়োজন মেটানো ও বেঁচে থাকার সামগ্রী সংগ্রহের জন্য এটাই দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম।
আল্লাহতায়ালা চাইলে এ নিয়মের বাইরেও রিজিক দিতে পারেন। কেননা, প্রকৃত রিজিকদাতা তিনিই এবং রিজিক দানের জন্য কোনো নিয়ম বা মাধ্যমের মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু দুনিয়া যেহেতু পরীক্ষার স্থান এবং আল্লাহতায়ালা মানুষকে সর্বাবস্থায় পরীক্ষা করে থাকেন, তাই মানুষের রিজিকপ্রাপ্তিকে একটা নিয়মের অধীন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষ কোনো একটা উপায় অবলম্বন করবে, কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত থাকবে এবং তার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে রিজিক হাসিল করবে।
এ কারণেই কোরআন-হাদিসে মানুষকে রিজিকের জন্য যেকোনো বৈধ উপায় অবলম্বনের প্রতি নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর ফজল সন্ধান করবে।’ -সূরা জুমআ : ৯
ইসলামি স্কলারদের মতে আয়াতে বর্ণিত ‘ফজল’ সন্ধান দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রিজিক সংগ্রহ করাকে বোঝানো হয়েছে। অন্য আয়াতে আছে, ‘যখন তোমরা ইহরামমুক্ত হবে, তখন শিকার করবে।’ -সূরা মায়িদা : ২
এভাবে নামাজ ও হজ আদায়ের পর ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিকারের কাজে লিপ্ত হওয়ার আদেশ দিয়ে এসব ফরজের পর রুজি-রোজগারের চেষ্টা করাও যে ফরজ সে দিকেই ইশারা করা হয়েছে। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসে এ ইশারা আরও স্পষ্টরূপে ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হালাল রুজি উপার্জন করা অপরাপর ফরজের পর একটি ফরজ কাজ।’
হালাল রুজি উপার্জনের বিভিন্ন মাধ্যম হতে পারে। তার মধ্যে কে কোনটা গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে যোগ্যতা, সুবিধা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। এসবের ভিত্তিতে যে ব্যক্তি যে কাজই বেছে নিক, হৃদয়ে ঈমান ও তাকওয়ার ঐশ্বর্য থাকলে তার জন্য কোনোটিই তুচ্ছ নয়। কাজেই যে ব্যক্তি যে পেশাই গ্রহণ করবে, তার কর্তব্য সে পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক থাকা। নিজ পেশার প্রতি যদি শ্রদ্ধার দৃষ্টি থাকে, তবে কাজ সুষ্ঠু ও সুচারু হতে বাধ্য।
কিন্তু আজকাল এ জিনিসের বড় অভাব। কাজে ফাঁকি দেওয়া কিংবা দায়সারাভাবে আঞ্জাম দেওয়া শ্রদ্ধাহীনতারই আলামত। এ আলামত আজকাল কোন ক্ষেত্রে না চোখে পড়ে? অথচ প্রতিটি পেশার ভেতরই এমন উপাদান নিহীত রয়েছে, যা শ্রদ্ধা কুড়ানোর ক্ষমতা রাখে। একটু চিন্তা করলেই আমরা সে ক্ষমতার স্পর্শ পেতে পারি এবং অন্তরে জাগাতে পারি আপন পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। চিন্তার শুরুটা এভাবে করা যায় যে, প্রত্যেকের পেশা আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তার রিজিক লাভের উসিলা। এ উসিলা অবলম্বনের আদেশ আল্লাহতায়ালাই তাকে করেছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কাজ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু পাওয়ার মাধ্যম বা উসিলা হয় সে কাজে শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক থাকা ঈমানের দাবি। ঈমানদার ব্যক্তি চিন্তা করবে যে, আপাত দৃষ্টিতে যদিও তার পেশাটি সে নিজেই বেছে নিয়েছে এবং কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাকে সে কাজে নিয়োগ দান করেছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতায়ালাই তার নিয়োক্তা। তার ওয়াদা রয়েছে যে, বান্দাকে তিনি রিজিক দান করবেন। সেই ওয়াদা পূরণেরই এটা এক ধরন যে, তিনি তাকে এ কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন।
সুতরাং প্রকৃত নিয়োগদাতা যখন আল্লাহতায়ালা তখন তার অসীম মর্যাদার কারণে এ নিয়োগও বিশেষ মর্যাদার হকদার। বিষয়টি এভাবে চিন্তা করলে তখন আর পেশাটা কী, মৌলিকভাবে তা বিবেচ্য থাকে না। সে বিবেচনার দরকার এ জন্যও পড়ে না যে, পেশা যাই হোক তা অবলম্বনের লক্ষ্য তো আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে রিজিক লাভ করা।
রিজিক আল্লাহতায়ালার অমূল্য দান, মহা নেয়ামত। পেশা যখন এই অমূল্য নেয়ামত হাসিলের মাধ্যম তখন নেয়ামতের মর্যাদায় পেশাও মর্যাদার বিষয় হবে বৈকি। অর্থাৎ মৌলিকভাবে বিবেচনা করতে হবে কাজের লক্ষবস্তুকে। লক্ষবস্তুর মহত্বের কারণে কাজও মহৎ হয়ে যায়।
বিষয়টি আমরা এভাবে চিন্তা করতে পারি যে, মানুষ যেহেতু সামাজিব জীব, তাই সমাজের বহুমুখী প্রয়োজন ও সামষ্টিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য দরকার বিভিন্ন গুণ ও বিচিত্র যোগ্যতাসম্পন্ন লোকসমষ্টির। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। একেকজন মানুষের একেক রকম যোগ্যতা, একেক রকম দক্ষতা।
মানুষ বর্ণ ও রূপে যেমন বৈচিত্রময়, তেমনি যোগ্যতা ও গুণেও বহুরঙ্গা। কারো আছে নেতৃত্বের গুণ, কারো চাষাবাদের। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের সমঝদার, কেউ স্থাপত্যের নিশানবরদার। কারো নেশা শিল্পকলায়, কারো বাক্যচর্চায়। এভাবেই মানবসমাজ কামার-কুমার, জেলে-সূতার, শিক্ষক-চিকিৎসক, উকিল-বিচারক নানা পেশার মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত।
সুতরাং বলতে পারি, মানবসমাজের পূর্ণতা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রত্যেকের যোগ্যতা তার সত্তায় গচ্ছিত এক পবিত্র আমানত। আমানতমাত্রই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে আমানতের আমানতকারী স্বয়ং রাব্বুল আলামীন, তার গুরুত্ব কি পরিমাপ করা যায়? প্রত্যেক পেশাদারই বিষয়টাকে তার ভাবনায় আনতে পারেন।
মোটকথা, পেশা যেটাই গ্রহণ করা হোক, তাতে যদি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির ছোঁয়া থাকে, তবে ব্যক্তির চোখে সে পেশা মহৎ হয়ে ওঠতে বাধ্য। তখন আর কোনো পেশাদারের চোখেই আপন পেশা হীন মনে হবে না।
হ্যাঁ, অপেক্ষাকৃত একটি অপেক্ষা অন্যটি শ্রেষ্ঠ হতে পারে, কিন্তু মাহাত্মের বহুমুখী উপাদান দৃষ্টে তুচ্ছ নয় কোনোটিই। কাজেই শ্রেষ্ঠটি কেন হস্তগত হলো না, সেই আক্ষেপ না করে উচিত আপন কাজের মর্যাদা উপলব্ধি করা। অন্তরে সেই উপলব্ধি এসে গেলে হীনম্মন্যতা বিদায় হবে এবং আপন পেশার প্রতি দৃষ্টি হয়ে উঠবে শ্রদ্ধাশীল, যা দায়িত্ব পালনে যত্নবান হওয়া ও কার্যে সুষ্ঠুতা আনয়নের জন্য অপরিহার্য।