সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনায় হজ অধিদফতর প্রতিষ্ঠা জরুরি

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আরাফাতের ময়দানে হাজিরা, ছবি: সংগৃহীত

আরাফাতের ময়দানে হাজিরা, ছবি: সংগৃহীত

২০২৫ সালের পবিত্র হজকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। সরকারিভাবে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ‘হজ প্যাকেজ-২০২৫’ ঘোষণার পর বেসরকারি হজ এজেন্সির দুটি গ্রুপ পৃথকভাবে ‘বেসরকারি হজ প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে।

যদিও ‘হজ প্যাকেজ ও গাইড লাইন ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, বেসরকারি মাধ্যমের হজযাত্রীদের জন্য ঘোষিত ‘সাধারণ হজ প্যাকেজ’ আবশ্যিকভাবে গ্রহণ এবং অতিরিক্ত সর্বোচ্চ একটি ‘বিশেষ হজ প্যাকেজ’ রাখতে পারবে এজেন্সিগুলো। কিন্তু বেসরকারি হজ এজেন্সির একটি গ্রুপ নিয়ম ভেঙে তিনটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা নিয়ম বহির্ভূত।

বিজ্ঞাপন

এই সমন্বয়হীনতার মধ্য দিয়ে হজ ব্যবস্থাপনায় একটা অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে। কারণ, এজেন্সির মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সি এসোসিয়েশনের বাংলাদেশ (হাব) বেসরকারি হাজিদের সেবা ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখভাল করে। হাবের সদস্যভুক্ত এজেন্সিগুলো একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু এজেন্সির মালিক এখানে গন্ডগোল পাকিয়ে কমিটি ভেঙে হাবে প্রশাসক এনেছেন, আলাদা আলাদা প্যাকেজ ঘোষণার কাজও সেরে ফেলেছেন। মূলত হাবকে কব্জা করে সুবিধা আদায়ই তাদের শেষ কথা, হাজিদের কল্যাণ, সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা তাদের বিষয় নয়। এভাবে চলতে থাকলে এবারের হজ ব্যবস্থাপনায় একটা বিপর্যয় আসবে, যার বদনাম পুরোটাই পড়বে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।

এবারের হজ প্যাকেজ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে, টাকা কমানো হলেও হাজিদের মক্কা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে থাকতে হবে। অনেকেই বলছেন, হজ প্যাকেজের দাম কম দেখানো হলো ঠিকই, কিন্তু হাজিদের মক্কা-মদিনা থেকে অনেক দূরে বাসা নিয়ে থাকতে হবে। অবধারিতভাবে হাজিদের যন্ত্রণায় ভুগতে হবে।

এই যে ‘যন্ত্রণা’, এটাই যেন হাজিদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। কোনোভাবে বাংলাদেশের হজযাত্রীরা এটা থেকে বের হতে পারছেন না। হজ আর যন্ত্রণা যেন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা মনে করি, সামগ্রিকভাবে হজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনলে, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন হজযাত্রীরা। আর এই কাজটা গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করতে পারে। তারা না পারলে ভবিষ্যতে কেউ করবে বা পারবে, সেই আশা দুরূহ।

বিজ্ঞাপন

হজের সময় হাজিদের কাছে হোটেলের মানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন হোটেল মসজিদে হারাম ও নববির কাছাকাছি। সেই সঙ্গে একটু ভালো খাবার এবং ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের ভালো ব্যবহার। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, হাজিরা প্রায় প্রস্তুত থাকেন- কষ্ট সহ্য করতে। কিন্তু সহ্যের সীমা বলে একটা কথা আছে!

হজযাত্রা বিশাল এক কর্মযজ্ঞের নাম। হাজিদের প্রস্তুতি, টাকা সংগ্রহ ও জমা, গ্রুপ মেলানো, উড়োজাহাজের টিকিট কাটা, মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া, মিনা ও আরাফাতে তাঁবুর বরাদ্দ নেওয়াসহ নানা আয়োজন থাকে। এর বাইরে নানা বয়সের নানা রুচির গয়রহ লোকদের একসঙ্গে করে হজের কাজ সম্পাদন করানো এবং তাদের থাকা-খাবারের ব্যবস্থা তো রয়েছেই। এতসব রুটিন কাজের বাইরে হঠাৎ কেউ হারিয়ে গেলে কিংবা অসুস্থ হলে সেটাও সামাল দিতে হয় এজেন্সির লোকদের। এসব কাজের কোনো পর্যায়ে হাজিরা যন্ত্রণাকাতর হতে পারেন, অবজ্ঞা-অবহেলার শিকার হতে পারে- তবে অধিকাংশ হাজি তা ভুলে যান।

কারণ বেশিরভাগ হাজি জীবনে একবার হজপালনে যান বলে এসবের বিরুদ্ধে সেভাবে কথা বলেন না, নিজেদের কষ্টের কথা বলতে পারেন না; প্রতিবাদ করেন না। তাই বলে, এগুলো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমলের বাইরে থাকতে পারে না। এর একটা সুরাহা দরকার। হজের মতো পবিত্র বিষয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বছরের পর বছর চলতে পারে না।

হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন হাজিরা, ছবি: সংগৃহীত

এ কারণে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার স্বার্থে দরকার হজ অধিদফতর। অধিদফতরের অধীনে একাধিক আঞ্চলিক হজ অফিস পরিচালিত হবে। এছাড়া অধিদফতর এবং এর অধীন দফতরের জন্য সরকার অনুমোদিত নির্দিষ্ট জনবল কাঠামো থাকবে। যারা সারা বছর হজ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবে। তাহলে আর শেষ মুহূর্তের কথা বলে তাড়াহুড়ার দোহাই দিয়ে হজ ব্যবস্থাপনায় কোনো ফাঁক-ফোকর রাখার সুযোগ থাকবে না।

হজের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সরকারের একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি বেসরকারি হজ এজেন্সি ও তাদের সংগঠন হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। হাবে নানা পক্ষ সক্রিয়, তবে এই মুহূর্তে হাবে কোনো কমিটি নেই। হাব চালাচ্ছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ পাওয়া একজন প্রশাসক। মনে রাখতে হবে, হাবের কমিটি না থাকা প্রকারান্তরে হাজিদের জন্য এক ধরনের অভিভাবকহীনতা। এই অভিভাবকহীনতার সুযোগ যে কেউ নিতে পারে। হজে যাওয়ার উদ্যোগের শুরু থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত হাজিদের হয়রানি এবং সরকারের দুর্নামের ছিদ্রগুলো এজেন্সিওয়ালাদের চেয়ে আর বেশি কেউ জানে না।

এই আশঙ্কা থেকে ভবিষ্যতের হজযাত্রীদের রক্ষা করতে হজ অধিদফতর হতে পারে সর্বোত্তম বিকল্প। দীর্ঘদিন ধরেই হজ সংশ্লিষ্টরা সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার স্বার্থে অধিদফতর গঠনের কথা বলে আসছেন। হজ অধিদফতর হলে সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে আরও বেশি সংখ্যক হজযাত্রী সৌদি আরব পাঠানো যাবে। এছাড়া অধিদফতর হজ ও উমরা ব্যবস্থাপনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী আকাশপথে অথবা সমুদ্রপথে হজযাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। এক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এয়ারলাইন্স বা সমুদ্রগামী জাহাজের ব্যবস্থা করা যাবে সহজেই। ফলে হজের খরচ অনেকটাই কমে আসবে।

হজ অধিদফতর ই-হজ ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে হজের কোটা গ্রহণ ও পূরণ, হজ প্যাকেজ ঘোষণা, হজযাত্রী প্রতিস্থাপন, ঢাকা হজ অফিস এবং মক্কা-মদিনা ও জেদ্দার অফিস পরিচালনা, হজ এজেন্সির লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, লাইসেন্স বাতিল বা সাময়িক স্থগিতকরণ, লাইসেন্স সমর্পণ, হজযাত্রী পরিবহন, রোড-টু-ইনিশিয়েটিভ মক্কাকে গতিশীল করা, উমরা ও হজযাত্রীদের জন্য মক্কা-মদিনায় আবাসন, হজগাইড নিয়োগ, অস্থায়ী হজ কর্মচারী নিয়োগ, হজ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দল প্রেরণ, আপদকালীন ফান্ড, এজেন্সি কর্তৃক অনিয়ম বা অসদাচরণের শাস্তি, দণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনা, বাতিল অথবা স্থগিত, হজসেবা উন্নতকরণে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা, বিভিন্ন অসুবিধা দূরীকরণসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

হজ অধিদফতর ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকবে। এক কথায়, এই অধিদফতরের অধীনে সরকারি-বেসরকারি উভয় ব্যবস্থাপনায় হজ ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হবে।

হজের টাকা নিয়ে এজেন্সির মালিক বা মধ্যস্বত্বভোগীদের চম্পট দেওয়ার ঘটনা অনেকেটাই কমেছে কিন্তু রিপ্লেসমেন্টসহ হজ ব্যবস্থাপনার সৌদি পর্বে রয়েছে নানা ঘাপলা। এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত। তাই সরকার ও দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি হজের ধর্মীয় তাৎপর্য ও পবিত্রতা বজায় রাখার স্বার্থে হজ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, গতিশীল ও জনবান্ধব করা আবশ্যক।

ভয়ভীতি, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে হজযাত্রা সাবলীল ও সহজ রাখার প্রক্রিয়া খুব কঠিন নয়। সততার সঙ্গে টাকা আয় করা দোষের কিছু নয়, কিন্তু হজযাত্রীদের জিম্মিদশায় ফেলে বাড়তি লাভের চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় ও হীন মানসিকতার পরিচায়ক। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। সামগ্রিকভাবে হজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা দরকার। আমরা চাই, যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আন্তরিকভাবে ভাববে।