ধর্মে ঝুঁকছে আজারবাইজান

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বাকুর একটি মসজিদে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা, ছবি: সংগৃহীত

বাকুর একটি মসজিদে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা, ছবি: সংগৃহীত

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে আর্মেনিয়ার কাছ থেকে মুক্ত হওয়া আজারবাইজানের আগদাম প্রদেশ সফরে যান দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ। ওই সফরে প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ এবং তার স্ত্রী মেহরিবান একটি পুরোনো মসজিদ পরিদর্শন করেন। তারা ওই মসজিদের ফটকে চুমু খেয়ে তাতে প্রবেশ করেন এবং স্বামী-স্ত্রী মিলে পবিত্র কোরআনের একটি কপি চুমু খেয়ে মসজিদে রেখে আসেন।

ওই মসজিদসহ আশপাশের এলাকা আর্মেনিয়ার কাছ থেকে মাত্র মুক্ত হয়েছে। এতদিন মসজিদটি বন্ধ ছিল, প্রেসিডেন্ট ইলহামের সফরের মধ্য দিয়ে মসজিদে পুনরায় নামাজ শুরু হয়। দেশটিতে অনেক পুরোনো মসজিদ রয়েছে, এগুলোকে মুসলমানরা বেশ সম্মানের চোখে দেখেন। প্রেসিডেন্টের মসজিদে সফর তারই বহিঃপ্রকাশ।

বিজ্ঞাপন

দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র ‘দ্য রিপাবলিক অব আজারবাইজান’ এশিয়া ও ইউরোপের মোহনায় অবস্থিত। ‘ইউরোশিয়া’ অঞ্চলের এশীয় দেশ আজারবাইজান। ৮৬ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটারের দেশটির একদিকে রয়েছে কাসপিয়ান সাগর আর অন্য তিন দিকে রয়েছে রাশিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, তুরস্ক ও ইরান। ১ কোটি ২০ লাখে জনসংখ্যার ৯৬.৯ শতাংশই মুসলিম।

পাহাড়-পর্বত, নদী, সাগর ও সবুজ ভূমিতে সমৃদ্ধ দেশ আজারবাইজান। রয়েছে তেল, গ্যাস ও লোহার মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। তবে তেল ও তেল শিল্পের ওপরই টিকে আছে দেশটির অর্থনীতি।

বিজ্ঞাপন

হিজরি প্রথম শতকেই আজারবাইজানে ইসলামের আগমন হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময়ে আজারবাইজানে ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসের নানা বাঁকে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে এই অঞ্চলে। এই সময় মিসর ও সিরিয়ার মুসলিম আরবরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। এ সময় মুসলিমরা আজারবাইজানের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হিজরি পঞ্চম শতকে আজারবাইজান সেলজুকদের শাসনাধীন হয়। সেলজুক শাসনামলে এই অঞ্চলে সুফিবাদের বিস্তৃতি ঘটে। সেলজুকদের পর আজারবাইজান উসমানীয় সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

আঠারো শতকের শেষভাগে প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকদের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকলে রাশিয়া তাদের ওপর চড়াও হয়। সীমান্তবর্তী মুসলিম দেশগুলোর ওপর তার হামলা ও আগ্রাসন বৃদ্ধি পায়। মুসলিম শাসকরা ওই অঞ্চল থেকে হাত গুটিয়ে নিলেও স্থানীয় মুসলিম নেতাদের কেউ কেউ প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। যা দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

১৮৫৯ সালে ইমাম শামিলের পরাজয় বরণের মধ্য দিয়ে অত্র অঞ্চলে রুশ আগ্রাসন রোধের শেষ সম্ভাবনাটুকু শেষ হয়ে যায়। আজারবাইজানের পূর্ণ ভূমি রাশিয়া পুরোপুরি দখল না করলেও এই অঞ্চলের মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিরোধ উসকে দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। অবশেষে ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর সমর্থনে রাশিয়া আজারবাইজানে প্রবেশ করে। ২১ অক্টোবর ১৯২০ জনগণের মতামত উপেক্ষা করে আজারবাইজানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ একটি পুরোনো মসজিদ পরিদর্শন করছেন, ছবি: সংগৃহীত

সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তির পর রুশ সরকার আজারবাইজানে সব ধরনের ধর্মচর্চার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। আরব সংস্কৃতির পরিবর্তে রুশ সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে লিপ্ত হয়। আগে আরবি বর্ণে আজারবাইজানি লেখা হলেও তার পরিবর্তে রুশ বর্ণে লেখার ফরমান জারি করা হয়। অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রুশ শাসনামলে আজারবাইজানে মসজিদের সংখ্যা দুই হাজার থেকে মাত্র ১৬-তে নেমে আসে। তবে স্বাধীনতার পর তা আবার বাড়তে থাকে।

বর্তমানে আজারবাইজানে এক হাজার ৮০০ মসজিদ রয়েছে। রুশ শাসনামলে বিপুলসংখ্যক রুশ নাগরিক আজারবাইজানে বসতি স্থাপন করে। যাদের সংখ্যা একসময় ১০ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৮ অক্টোবর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আজারবাইজান।

স্বাধীনতা লাভের পরও আজারবাইজানের রাষ্ট্র ও সমাজে রুশ শাসনের কালো দাগ রয়ে গেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলিম হলেও আজারবাইজান একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দেশের বেশির ভাগ নাগরিক এখনো ধর্মবিমুখ। মুসলিম জনগণের খুব সামান্য অংশই ধর্মপরায়ণ। তবে আশার কথা হলো, তরুণ প্রজন্ম ইসলামপরায়ণ। তারা ক্রমেই ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে।

বাকু রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিআরআই)-এর এক প্রতিবেদনে ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আজারবাইজানের মুসলমানের ধর্মীয় প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে। যাতে দেখানো হয়েছে, এই তিন বছরে ধর্মবিমুখতার হার ৫৯ থেকে ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ধার্মিকদের সংখ্যা ১৬ থেকে ৩৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

একই সঙ্গে সে দেশে মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি নমনীয় হচ্ছে। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় আজারবাইজানে মাত্র একটি মাদরাসা (ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ছিল। ২০০০ সালে যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০-এ। যার মধ্যে সরকার অনুমোদিত ৩০টি মাদরাসা রয়েছে। বাকুতে অবস্থিত মাদরাসাটিকে ১৯৯২ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়।

সম্প্রতি সরকার সাতটি ইসলামিক কলেজের অনুমোদন দিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে অতিদ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। সব মিলিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে আজারবাইজানের মুসলিমরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত এক দশক ধরে আজারবাইজানে নবজাতক শিশুদের নামের তালিকায় ইসলামি নাম শীর্ষে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আজারবাইজানের জনগণের ইসলাম ধর্মের প্রতি অধিক আকৃষ্ট হওয়ার ফলে সেদেশের নবজাতক শিশুদের ধর্মীয় নাম রাখার প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে।