যেসব কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হয়েছে
-
-
|
![মাদায়েন শহরের ধ্বংসাবশেষ, ছবি: সংগৃহীত](https://imaginary.barta24.com/resize?width=1280&quality=75&type=webp&path=uploads/news/2025/Jan/25/1737810825521.jpg)
মাদায়েন শহরের ধ্বংসাবশেষ, ছবি: সংগৃহীত
‘কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আজাব অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আজাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোনো কথাই ছিল না যে, সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম।’ -সুরা আল আরাফ : ৪-৫
কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী ইবরাহিমের জাতি এবং আদ, সামুদ ও নুহের জাতিসমূহ এবং মাদায়েনবাসী ও মুতাফিকাতধারীদের ইতিহাস কি তারা জানে না? তাদের কাছে নবীরা সুস্পষ্ট নির্দেশমালা নিয়ে এসেছিলো। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেননি বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। পক্ষান্তরে ঈমানদার নারী-পুরুষেরা পরস্পরের মিত্র ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে।’ -সূরা তাওবা : ৭০-৭১
আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির ইতিহাস বিশ্ববাসীর শিক্ষা গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করেছেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের প্রত্যেককে আমি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককে ধ্বংস করে দিয়েছি। আর সেই জনপদের ওপর দিয়ে তো তারা যাতায়াত করেছে, যার ওপর নিকৃষ্টতম বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়েছিল। তারা কি তার অবস্থা দেখে থাকেনি? প্রকৃতপক্ষে এরা পরকালে ফিরে যেতে হবে তা চিন্তা করে না।’ -সুরা ফুরকান : ৩৯-৪০
কোরআনে কারিমে এ সংক্রান্ত অনেক আয়াত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ সব জাতির ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে তাদের নবী ও রাসুলদের অস্বীকার, অসৌজন্যমূলক আচরণ ও হত্যা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন ‘এদের পূর্বে নুহের কওম, আসহাবুর রাস, সামুদ,আদ, ফেরাউন, লুতের ভাই, আউকাবাসী এবং তুব্বা কওমের লোকেরাও অস্বীকার করেছিল। প্রত্যেকেই রাসুলদের অস্বীকার করেছিল এবং পরিণামে আমার শাস্তির প্রতিশ্রুতি তাদের জন্য কার্যকর হয়েছে।’ -সূরা কাফ : ১২-১৪
এ ছাড়া ধ্বংসের আরও বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যখনই কোনো জাতি আল্লাহর হেদায়েত থেকে মুখ ফিরিয়ে তাগুতের নেতৃত্বে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে এবং পৃথিবীকে মানুষের বাস অনোপযোগী করে তুলে এবং পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব দুঃসহ এক অভিশাপে পরিণত হয়, তখন আল্লাহর আজাব এসে তাদের নাপাক অস্তিত্ব থেকে দুনিয়াকে মুক্ত করে।
এখানে কোরআনে কারিম উল্লেখিত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ধ্বংসের কারণ বর্ণনা করা হলো-
আদ
কোরআনে কারিমের সূরা আরাফ, সূরা হুদ, সূরা মুমিন ও সূরা আহকাফ, সূরা শুরা, সূরা আল আনকাবুত ও সূরা হা-মীম আস সেজদায় এ জাতির আলোচনা করা হয়েছে।
হজরত হুদ (আ.) কে এ জাতির কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। আদ ছিল আরবের প্রাচীনতম জাতি। তাদের অতীত কালের প্রতাপ-প্রতিপত্তি ও গৌরব গাঁথা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। তারপর দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নাম নিশানা মুছে যাওয়াটাই প্রবাদের রূপ নিয়েছিল। কোরআনে কারিমের বর্ণনা মতে, এ জাতির আবাসস্থল ছিল ‘আহকাফ’ এলাকা। এ এলাকাটি হেজায, ইয়েমেন ও ইয়ামামার মধ্যবর্তী ‘রাবয়ুল খালি’র দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত।
ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে তাদের আবাসভূমি ওমান থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃৃত ছিল। কোরআন মাজিদ থেকে তাদের ধ্বংসের কারণ জানা যায়। জুলুমই ছিল তাদের ধ্বংসের প্রধান কারণ।
সামুদ
আরেকটি পরিচিত জাতির নাম সামুদ। কোরআন মাজিদের সূরা আরাফ, সূরা হুদ, সূরা হিজর ও সূ নামলে এ জাতির আলোচনা করা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম আরবের যে এলাকাটি আজও ‘আল-হিজর’ নামে খ্যাত, সেখানেই ছিল তাদের আবাস।
বর্তমান সৌদি আরবের অন্তর্গত মদিনা ও তাবুকের মাঝখানে হেজাজ রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে, তার নাম মাদায়েনে সালেহ। এটিই ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান। সামুদ জাতি পাহাড় কেটে যে সব বিপুলায়তন ইমারাত নির্মাণ করেছিল, এখনও হাজার হাজার একর এলাকাজুড়ে সেগুলো অবস্থান করছে। তাবুক যুদ্ধের সময় নবী কারিম (সা.) যখন এ এলাকা অতিক্রম করেছিলেন, তখন তিনি মুসলমানদের এ শিক্ষণীয় নিদর্শনগুলো দেখান এবং এবং এমন শিক্ষাদান করেন যাতে একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। তাদের ধ্বংসের কারণ ছিল, তারা দাম্ভিক ছিল এবং অন্যের ওপর জুলুম করেছিল। ফলে তারা ভূমিকম্পের দ্বারা পাকড়াও হলো।
লুত সম্প্রদায়
আরেক পরিচিত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি হলো- লুত। কোরআন মাজিদের সূরা আরাফ ও সূরা কাফে এ জাতির আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান যে এলাকাটিকে ট্রান্সজর্ডান বলা হয় সেখানেই ছিল এ জাতির বাস। ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থানে এ এলাকাটি অবস্থিত।
মিথ্যা, ধোঁকা, প্রতারণা ও ব্যভিচারসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করেনি। সবশেষ নতুন যে পাপটি তারা আবিষ্কার করে সেটি হলো- সমকামিতা। এটি করে প্রকাশ্যে আনন্দ-উল্লাস করত তারা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর লুতকে আমি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম। আমি তাকে এমন এক জনপদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম, যার অধিবাসীরা অশ্লীল কাজে লিপ্ত ছিল। তারা ছিল এক মন্দ ও পাপাচারী কওম। আর আমি তাকে আমার রহমতের মধ্যে শামিল করে নিয়েছিলাম। সে ছিল সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।’ -সূরা আম্বিয়া : ৭৪-৭৫
তাফসিরকারকরা বলেন, সমকামিতার মহাঅপরাধে হজরত লুত (আ.)-এর জাতির ওপর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাপ্রলয় নেমে আসে। এক শক্তিশালী ভূমিকম্প পুরো নগরটি সম্পূর্ণ উল্টে দেয়। ঘুমন্ত মানুষের ওপর তাদের ঘরবাড়ি আছড়ে পড়ে। পাশাপাশি আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। ওই মহাপ্রলয়ের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি।
হজরত লুত (আ.)-এর জাতির ধ্বংসস্থলটি বর্তমানে ডেড সি বা মৃত সাগর নামে পরিচিত। ফিলিস্তিন ও জর্দান নদীর মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল অঞ্চলজুড়ে নদীর রূপ ধারণ করে আছে এটি। এতে কোনো ধরনের জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না।
ধ্বংসপ্রাপ্ত আরও কিছু সম্প্রদায়
কোরআন মাজিদে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর মধ্যে আরও যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে, তারা হলো- আহলে মাদইয়ান, সাবা জাতি, তুব্বা জাতি, বনী ইসরাঈল জাতি, আসহাবে উখদুদ, আসহাবুল কারিয়্যা, আসহাবুস সাবত, আসহাবুল রাস ও আসহাবে ফিল উল্লেখযোগ্য। তাদের প্রত্যেকের ধ্বংসের কারণ ছিল আবাধ্যতা, সীমালংঘন, জঘন্যতম কাজে লিপ্ত হওয়াসহ মানুষকে জুলুম করা এবং নিজেদের ওপরও জুলুম করা।
কোরআন মাজিদে তাদের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে পৃথিবীর মানুষেরা তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।