জাকাত অনাদায়ের পরিণতি
ইসলামের মূল পাঁচ রোকনে একটি হলো- জাকাত। নামাজ ও রোজাকে শারীরিক ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। আর হজকে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতের সমন্বয় হিসেবে গণ্য করা হয় ৷ নিরেট আর্থিক ইবাদত একমাত্র জাকাত।
জাকাত কী?
আরবি জাকাত শব্দের অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা, পরিশুদ্ধি ৷ বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যায়, জাকাত দানে সম্পদ কমে যায় ৷ কেননা একশ’ টাকার জাকাত আড়াই টাকা দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকে সাড়ে সাতানব্বই টাকা ৷ তাহলে সম্পদের বৃদ্ধি কোথায়?
মূলতঃ জাকাত দেওয়ার কারণে আল্লাহ তাকে এমন আগাম বিপদ থেকে রক্ষা করেন, যা তার জানা ছিল না ৷ হয়ত সেই বিপদে পতিত হলে অনেক বেশি টাকা তাকে খরচ করতে হতো ৷ জাকাতের অল্প টাকা ব্যয় করে বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয় করা থেকে সে বেঁচে গেল, এটাই বৃদ্ধি।
জাকাতের প্রয়োজনীয়তা
জাকাতের অংশটুকু সম্পদের ময়লা, এটা বের না করলে পুরো সম্পদ ময়লাযুক্ত হয়ে ব্যবহার অযোগ্য হবে ৷ যেমন কেউ এক হাজার টাকা খরচ করে জামা তৈরি করল, কয়েকবার ব্যবহারের পর জামাটি ময়লা হয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ল ৷ এখন ৮-১০ টাকা খরচ করলে পুরো জামাটা পরিচ্ছন্ন হবে আবার ব্যবহারযোগ্য হবে ৷ এমনিভাবে শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত দিলে পুরো সম্পদটাই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হবে এবং ব্যবহারযোগ্য হবে ৷
মানুষ যদি মনে করে, এত কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করেছি, কেন আমি তা থেকে অন্যকে দেব? এ কথা তো অনেকটা ওই ব্যক্তির ভাবনার মতো হবে, যে আঙুর, বেদানা, ফল-ফলাদি ইত্যাদি ভিটামিন জাতীয় অনেক খেয়েছে। এবার ভাবছে, এগুলো আমি পেট থেকে বের হতে দেবো না ৷ কারণ অনেক পয়সা খরচ করে আমি খেয়েছি ৷ স্বাভাবিকভাবে যখন সে পেট থেকে বের হতে দেবে না, ২৪ কিংবা ৪৮ ঘন্টা পর দেখা যাবে অপারেশন করে হলেও তাকে তা বের করতে হবে ৷
এমনিভাবে কেউ যদি স্বাভাবিকভাবে জাকাতের অর্থ ব্যয় করতে কার্পণ্য করে, দেখা যাবে আল্লাহ এমন অবস্থা সৃষ্টি করে দেবেন শুধু আড়াই টাকা নয় আড়াই লাখ টাকা তাকে খরচ করতে হবে ৷ তাই সম্পদের মালিককে বুঝতে হবে, জাকাত তার হক নয়, গরীব-মিসকিনের হক ৷ তাদেরকে তাদের হক কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব করে দিয়ে দিতে হবে ৷
ইসলামি পরিভাষায় জাকাত
ইসলামি পারিভাষায় জাকাত হচ্ছে, মুসলিম বিত্তবানদের (নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক) ধন-সম্পদে আল্লাহ নির্ধারিত সেই অপরিহার্য অংশ, যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় শরিয়ত নির্ধারিত খাতে ব্যয়-বন্টন করার জন্য দেওয়া হয় ৷
জাকাতের গুরুত্ব
ইসলামি শরিয়তে জাকাতের গুরত্ব নামাজের গুরুত্বের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় ৷ কোরআনে কারিমের অধিকাংশ জায়গায় নামাজের সঙ্গে জাকাতের আদেশও দেওয়া হয়েছে ৷ যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো।’ -সূরা বাকারা: ১১০
হজরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফত লাভের পর একদল লোক জাকাত দিতে অস্বীকার করে। হজরত আবু বকর (রা.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ৷ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম আমি সেসব লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ গোষণা করব, যারা নামাজ ও জাকাতের মাঝে পার্থক্য করে ৷ নামাজ শরীরের হক আর জাকাত হলো- সম্পদের হক ৷ আল্লাহর কসম কেউ যদি একটি উটের বাচ্চা অথবা একটি উটের রশি জাকাত হিসেবে দিতে অস্বীকার করে যা রাসূলের যুগে দিয়েছিল, আমি তার বিরুদ্ধেও লড়াই করব।’
দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত
দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবি হজরত মুয়াজ (রা.) কে ইয়েমেনে প্রেরণকালে বলেছিলেন, ‘তুমি তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তাদের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন, যা ধনীদের নিকট থেকে নেওয়া হবে আর দরিদ্র্যদের মাঝে বন্টন করে দেওয়া হবে।’ আল্লাহ জাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাত হিসেবে প্রথমে ফকির-মিসকিনের কথা উল্লেখ করেছেন ৷ এতে বুঝা যায়, দারিদ্র্য বিমোচন জাকাতের মূল লক্ষ্য ৷ আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তাদের সম্পদ হতে জাকাত গ্রহণ করো, যা দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে আর তাদের জন্য দোয়া করো, নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তির কারণ আর আল্লাহ খুব শোনেন, খুব জানেন।’ -সূরা তাওবা: ১০৩
জাকাত না দেওয়ার পরিণাম
কোরআন-হাদিসে জাকাত আদায় না করায় কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে ৷ এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে সম্পদ দান করেছেন তাতে তারা কৃপণতা করে, (জাকাত আদায় না করে) এটা যেন তারা কিছুতেই কল্যাণকর মনে না করে বরং এটা তাদের জন্য অকল্যাণকর ৷ যাতে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন তা তাদের গলার বেড়ি হবে।’ ¬-সূরা আলে ইমরান: ১৮০
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে রাখে এবং সেসব আল্লাহর পথে ব্যয় করে না (অর্থাৎ জাকাত আদায় করে না) তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও ৷ সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং এসব দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে, সেদিন বলা হবে, এটা তোমার সেই সম্পদ যা তুমি পুঞ্জিভূত করে রেখেছিলে ৷ সুতরাং এর শাস্তি আস্বাদন করো ৷’-সূরা তওবা: ৩৪-৩৫
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যাক্তিকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন আর সে ধন-সম্পদের জাকাত আদায় করেনি সেই সম্পদ কিয়ামতের দিন মাথায় টাক পড়া সাপে পরিণত হবে ৷ এ সাপের দু’চোখের ওপর দু’টি কালো দাগ থাকবে (অর্থাৎ খুবই বিষধর সাপ) ৷ এরপর এ সাপ গলায় বেড়ি হয়ে সেই ব্যাক্তির দুই চোয়াল আকড়ে ধরে দংশন করবে আর বলবে, আমি তোমার মাল আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ ৷’-সহিহ বোখারি: ২/১০৬
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদের সম্পদ বিষধর সাপের রূপ ধারণ করবে ৷ মালিক এর থেকে পলায়ণ করবে, সাপ মালিককে খুঁজতে থাকবে ৷ পরিশেষে সে মালিককে পেয়ে যাবে এবং তার আঙ্গুলগুলোকে লোকমা বানিয়ে মুখে পুরবে ৷’-মুসনাদে আহমদ: ১৩/৫১৩
লেখক: মুহাদ্দিস, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার কক্সবাজার।