কষ্ট ও অভাব অপেক্ষা করছে কৃপণদের জন্য
১. শপথ রাতের যখন সে আচ্ছন্ন করে, ২. শপথ দিনের যখন সে আলোকিত হয়, ৩. এবং শপথ তার, যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন, ৪. নিশ্চয় তোমাদের কর্ম প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরনের; ৫. অতএব, যে দান করে এবং আল্লাহভীরু হয়, ৬. এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, ৭. আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্যে সহজ পথ দান করব; ৮. আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয়, ৯. এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, ১০. আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্যে সহজ পথ দান করব; ১১. যখন সে অধঃপতিত হবে তখন তার সম্পদ তার কোনোই কাজে আসবে না, ১২. আমার দায়িত্ব পথ প্রদর্শন করা, ১৩. আর আমি মালিক ইহকালের ও পরকালের, ১৪. অতএব, আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি, ১৫. এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে, ১৬. যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়; ১৭. এ থেকে দূরে রাখা হবে আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে, ১৮. যে আত্মশুদ্ধির জন্যে তার ধন-সম্পদ দান করে, ১৯. এবং তার ওপর কারও কোনো প্রতিদানযোগ্য অনুগ্রহ থাকে না, ২০. তার মহান পালনকর্তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত, ২১. সে সত্বরই সন্তুষ্টি লাভ করবে। -সূরা আল লাইল এর অনুবাদ
সূরা আল লাইল কোরআনে কারিমের ৯২তম সূরা। হিজরতের আগে মক্কায় এ সূরাটি নাজিল হয়। সূরায় ২১টি আয়াত রয়েছে। সূরা লাইলের প্রথমে রাত-দিনের শপথ নিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। এরপর শপথ নিয়েছেন নর-নারীর স্রষ্টা হিসেবে নিজের। এরপর খোদাভীরু ও দানশীল এবং কৃপণ মানুষের পরিণতি সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। বলা হয়েছে, কৃপণদের জন্য অপেক্ষা করছে দুর্ভাগ্য ও কষ্ট এবং অভাব। অন্যদিকে দানশীলদের জন্য অপেক্ষা করছে সুদিন, সৌভাগ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য। আল্লাহতায়ালাই যে মানুষকে সুপথ দেখান ও অস্তিত্ব জগতের সবকিছুর ওপর রয়েছে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও মালিকানা তা উল্লেখ করা হয়েছে এ সূরায়।
পাপী ও আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকারকারী এবং দোজখের প্রজ্জ্বলিত আগুন থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে সূরা আল লাইলে। আল্লাহতায়ালা এ সূরায় বদান্যতার প্রশংসা ও কৃপণতার নিন্দা করে বলেছেন, মৃত্যুর পর ধন-সম্পদ কোনো কাজে আসবে না। এ সূরায় আরও বলা হয়েছে, ধর্ম তথা শরিয়তের কর্তব্য কেবল পথ প্রদর্শন করা, আর পরহেজগার ব্যক্তি এবং দানশীল ও উদার ব্যক্তিকে জাহান্নাম হতে রক্ষা করা হবে।
সূরার চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, নিশ্চয় তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরনের। এ আয়াতের শানে নুজুল হলো- এক ধনী আনসারি সাহাবির একটি খেজুর গাছের কিছু শাখা এক প্রতিবেশীর ঘরে ঝুঁকে পড়েছিল। আর সেই প্রতিবেশী স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অত্যন্ত কষ্টে জীবন কাটাত। যখন সেই আনসারি ওই গাছের খেজুর সংগ্রহ করত তখন এক-আধটা খেজুর পড়ে গেলে প্রতিবেশীর সন্তানরা সেগুলো কুড়িয়ে নিত। কিন্তু সে তাদের কাছ থেকে সেসব খেজুর কেড়ে নিত, এমনকি কখনও কখনও শিশুদের মুখ থেকেও বের করে নিত। ওই প্রতিবেশী একদিন নবী করিম (সা.)-কে এ ব্যাপারে নালিশ করেন। তিনি সেই কৃপণকে ডেকে বললেন, তুমি যদি এই গাছকে জান্নাতের খেজুর গাছের বিনিময়ে বিক্রি করো তাহলে আমি তা কিনব। সে তার খেজুর গাছগুলোর মধ্যে ওই গাছের খেজুরই উৎকৃষ্ট বলে অজুহাত দেখিয়ে রাজি হলো না।
তখন আবু বিজদা নামের এক সাহাবি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি যদি এই গাছ কিনে দেই তবে কি এর বিনিময়ে আমাকে জান্নাতের খেজুর গাছ দেওয়া হবে? তিনি বললেন, অবশ্যই।
এ অবস্থায় আবু বিজদা বহু অনুরোধ করে চল্লিশটি খেজুর গাছের বিনিময়ে আনসারির সেই বিশেষ খেজুর গাছটি কিনে নিয়ে লোকদের তার সাক্ষী করেন এবং গাছটি নবীকে (সা.) উপহার দেন। এরপর নবী করিম (সা.) আবু বিজদাকে জান্নাতের গাছের প্রতিশ্রুতি দানের বিনিময়ে ওই খেজুর গাছটি আনসারির সেই দরিদ্র প্রতিবেশীকে মালিক বানিয়ে দেন। এ অবস্থায় আবু বিজদার প্রশংসায় ও সেই আনসারির নিন্দায় নাজিল হয় সূরা লাইলের চতুর্থ আয়াত এবং দানশীলতার সুফল ও কৃপণতার কুফল তুলে ধরা হয় এ সূরায়।
সূরা লাইলের তৃতীয় আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, শপথ তার, যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন। নর ও নারী আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি কৌশলের সাক্ষ্য। নর-নারীর যুগল প্রজাতি রয়েছে মানুষ, উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবের মধ্যেও। নর-নারীর প্রকৃতি ও কর্ম তৎপরতার মধ্য রয়েছে ভিন্নতা।
এরপর মানুষের প্রচেষ্টাগুলোর ভিন্নতার কথা এসেছে সূরা লাইলে। মানুষের স্বভাব, সখ ও প্রকৃতির আলোকে তাদের তৎপরতাও হয় ভিন্ন। আল্লাহর দেওয়া জীবন বা আয়ু নামক পুঁজিটি যেন পণ্ডশ্রমের শিকার না হয় বা খুব কমমূল্যে বিসর্জন না দেওয়া হয় সে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এখানে। জীবন যদি কাটে ভালো কাজে ও আল্লাহর পছন্দনীয় পথে তাহলেই তা হবে স্বার্থক ও তা বয়ে আনবে সৌভাগ্য।
সূরা লাইলের পঞ্চম আয়াত অনুযায়ী মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। একদল খোদাভীরু ও সৎকর্মশীল এবং দানশীল আর অন্য দল কৃপণ ও খোদায়ি পুরস্কারকে মিথ্যা বলে মনে করে। অন্য দলটি বেছে নিয়েছে যন্ত্রণা ও জাহান্নামের পথ। পরকালে তাদের পার্থিব সম্পদ কোনো কাজে আসবে না। ওইসব সম্পদ তারা যেমন সঙ্গে করে পরকালে আনতে পারবে না তেমনি যদি আনতেও পারত তবু তা জাহান্নামের আগুন থেকে তাদের রক্ষা করতে পারত না।
কার্পণ্য আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস থেকে উৎসারিত হয়। এই অবিশ্বাসের কারণেই তাদের জন্য সৎ কাজ করা ও বিশেষ করে দান করা হয় খুবই কষ্টকর বা অপছন্দনীয় কাজ। অন্যদিকে খোদাভীরুদের জন্য সৎ কাজ ও দান-খয়রাত করা আনন্দদায়ক ও প্রাণ সঞ্জীবক।
সূরা লাইলের ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, সুপথে পরিচালনা তারই কাজ। বিশ্বের প্রতিটি বস্তু এবং অনু-পরমাণু খোদায়ী বিধান মেনে চলে ও নিখুঁতভাবে বিশেষ নিয়ম মেনে চলেই তারা এগিয়ে যায় নির্ধারিত পূর্ণতায়। একইভাবে আল্লাহ মানুষকে দেখান সুপথ এবং আল্লাহ নিজের জন্য এ কাজ অপরিহার্য করে নিয়েছেন। কিন্তু সুপথ পেতে চাইলে মানুষকেও তা চাইতে হবে, এ পথে সচেষ্ট হতে হবে যাতে তারা পায় কল্যাণ ও সৌভাগ্য।