রমজানের আগাম খবর দিলেই জাহান্নাম হারাম হয় না
বেশ কয়েক বছর যাবত দেখছি, রমজানের কয়েক মাস বাকি থাকতে অনেকের ‘জাহান্নাম থেকে মুক্তি আর জান্নাত লাভের হিরিক লেগে যায়!’ এ কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি লেখা শেয়ার করেন, ‘যে ব্যক্তি সবার আগে কাউকে রমজানের সুসংবাদ দেয়, তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়।’ ‘যে ব্যক্তি সবার আগে কাউকে রমজানের সুসংবাদ দেয়, তার জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ।’
অনেকে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে, বিভিন্ন নিউজপোর্টালের কমেন্টবক্সে, ব্যক্তিগত ইনবক্সে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বলে শেয়ার করেন, অন্যকে শেয়ার করতে উদ্ধুব্ধ করেন। অথচ বর্ণিত বক্তব্য দু’টো হাদিস নয়, কোনো হাদিসের মর্মার্থ কিংবা ভার্বাথও নয়। এগুলো ভুয়া, বানোয়াট ও মনগড়া কথা। হাদিসের নামে ডাহা মিথ্যাচার, চরম জালিয়াতি।
ধর্মীয় বিভিন্ন বক্তব্যের প্রতি মানুষের এক ধরণের দূর্বলতা রয়েছে। সেই দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সস্তা লাইক-কমেন্ট কামানোর ধান্ধায় এসব কথা হাদিস বলে প্রচার করে এক শ্রেণির লোক। বলি, জাহান্নামের আগুন হারাম হওয়া কী এত সহজ? যে একটি সংবাদ দিলেই জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে? তাও আবার ভুয়া সংবাদের মাধ্যমে? বরং এই ভুয়া-বানোয়াট কথা হাদিসের নামে প্রচার করার কারণে জাহান্নামের আগুন তার জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে, যদি মৃত্যুর আগে তওবা না করে।
ইসলামের শিক্ষা হলো, কোনো সংবাদ এলে তা যাচাই-বাছাই করে বিশ্বাস করতে হবে। সেখানে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে কোনো কথা শুনছেন, সেটা কোনো ধরনের চিন্তা-ভাবনা ছাড়া বিশ্বাস করে প্রচার শুরু করে দেওয়া চরম মূর্খতা। এ ধরনের কথা প্রচার অজ্ঞতার শামিল ও চরম চরম উদাসীনতা। হাদিসের নামে এ ধরণের মিথ্যাচার পরিহার করা ঈমানি-কর্তব্য।
আল্লাহতায়ালার স্পষ্ট হুকুম হচ্ছে, কোনো সংবাদ কানে এলে আগে তার সত্যতা সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করতে হবে। এটা সাধারণ সংবাদবিষয়ক নির্দেশনা।
সেখানে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নামে কোনো সংবাদ এলে সেটা তো আরও গুরুত্ব সহকারে যাচাই করেই তবে প্রচার করার কথা ছিল। এটা না করে ঢালাও প্রচার মারাত্মক গোনাহের কাজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।’ –সূরা নাহল: ১১৬
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আমার ওপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।’ –সহিহ বোখারি: ১১০
ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে, যে রাসূল (সা.)-এর ওপর মিথ্যা বলবে সে যেন নিজ ঠিকানা স্থায়ী জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।’ -তারিকুল হিজরাতাইন: ১৬৯
সুতরাং, আমাদের অনুরোধ থাকবে- ভুয়া-বানোয়াট কথা হাদিসের নামে প্রচার করা থেকে সবাই সাবধান থাকুন, সহজে জান্নাত পাওয়ার লোভে নিজের স্থায়ী ঠিকানা জাহান্নাম বানাবেন না।
তবে রমজান মাসের আগমন উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো, প্রস্তুতির কথা বলা দোষণীয় কোনো বিষয় নয়। কেননা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের রমজানের আগমন উপলক্ষে সুসংবাদ দিতেন এবং তাদের উত্তম আমলসমূহের জন্য প্রস্তুতি নিতে উৎসাহিত করতেন।
এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত সালমান ফারসি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, শাবান মাসের শেষ দিনে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন।
ওই ভাষণে তিনি বলেন, হে লোক সকল! একটি মহিমান্বিত মাস তোমাদেরকে ছায়া হয়ে ঘিরে ধরেছে। এ মাস একটি বরকতময় মাস। এটি এমন এক মাস, যার একটি রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহতায়ালা এ মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন আর নফল করে দিয়েছেন এ মাসে রাতের কিয়ামকে। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল কাজ করবে, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ সম্পাদন করল। এ মাস সবরের (ধৈর্যের) মাস, সবরের সওয়াব জান্নাত। এ মাস সহমর্মিতার। এ এমন এক মাস যাতে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, এ ইফতার তার গোনাহ মাফের কারণ হবে, হবে জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়। তার সওয়াব হবে রোজাদারের অনুরূপ। অথচ তার (রোজাদার) সওয়াব একটুও কমানো হবে না।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সবাইতো রোজাদারের ইফতারির আয়োজন করতে সমর্থ নেই। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এ সওয়াব আল্লাহতায়ালা ওই ইফতার পরিবেশনকারীকেও প্রদান করবেন, যে একজন রোজাদারকে এক চুমুক দুধ, একটি খেজুর অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে ইফতার করায়। আর যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পেট ভরে খাইয়ে পরিতৃপ্ত করল, আল্লাহতায়ালা তাকে আমার হাউজে কাওসার থেকে এভাবে পানি খাইয়ে পরিতৃপ্ত করবেন-যার পর সে জান্নাতে (প্রবেশ করার পূর্বে) আর পিপাসার্ত হবে না। এমনকি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা এমন এক মাস যার প্রথম অংশে রহমত। মধ্য অংশে মাগফিরাত আর শেষাংশে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত। যে ব্যক্তি এ মাসে তার অধীনস্তদের ভার-বোঝা সহজ করে দেবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন।’ -মিশকাতুল মাসাবিহ, কিতাবুস সাওম, হাদিস নং: ১৯৬৫
হাদিসে রমজান মাস সম্পর্কে এভাবেই বলা হয়েছে। এর বাইরে অন্য কিছু বলা হয়নি। সুতরাং রমজান মাসের আগমনের খবর সবার আগে অন্যকে জানালে জাহান্নাম হারাম হবে- এমন কথা ঠিক নয়। এগুলো বলা ও প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। আর রমজান মাসের আগমনের খবর অন্যকে জানানো যাবে, যাতে তারা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে। এর বাইরে অন্যকিছু নয়।