অমুসলিমদের সঙ্গে সদয় আচরণ ইসলামের শিক্ষা
চলতি রমজানের চতুর্থ তারাবিতে তেলাওয়াত করা হবে সূরা নিসার ৮৮ নম্বর আয়াত থেকে সূরা মায়েদার ৮২ নম্বর আয়াত পর্যন্ত।
তেলাওয়াতকৃত অংশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হলো, অমুসলিমদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের নির্দেশনাটি হাফেজ সাহেবরা ছয় ছয় বার তেলাওয়াত করবেন আলাদা আলাদা ছয় আয়াতে। ওই সব আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
‘তারা চায় যে, তারা যেমন কাফের, তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সব সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে।’ –সূরা নিসা: ৮৯
‘সে সকল মুনাফিককে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব যারা মুসলমানদের বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ যাবতীয় সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।’ –সূরা: ১৩৯
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা কাফেরদেরকে বন্ধু বানিও না মুসলমানদের বাদ দিয়ে। তোমরা কি এমনটি করে নিজেদের ওপর আল্লাহর প্রকাশ্য প্রমাণ কায়েম করে দেবে?’ -সূরা নিসা: ১৪৪
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তুর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।’ -সূরা মায়েদা: ৫১
‘হে মুমিনগণ! আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা ঈমারদার হও।’ -সূরা মায়েদা: ৫৭
‘আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা নিজেদের জন্য যা পাঠিয়েছে তা অবশ্যই মন্দ। তা এই যে, তাদের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা চিরকাল আজাবে থাকবে। যদি তারা আল্লার প্রতি ও রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত, তবে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই দূরাচার।’--সূরা মায়েদা: ৮০-৮১
গুরুত্বপূর্ণ এ নির্দেশনাটি শুধুমাত্র ছয় বার নয়, কোরআনের অন্যত্র আরও তিন বার ঘোষিত হয়েছে। যথা-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোনো ত্রুটি করে না। তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুঁটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশি জঘন্য। তোমাদের জন্য নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেওয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও।’ -সূরা আলে ইমরান: ১১৮
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় পিতা ও ভাইদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালোবাসে। আরা তোমাদের থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে তারা সীমালংঘনকারী।’ -সূরা তাওবা: ২৩
‘মুমিনগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।’ -সূরা মুমতাহিনা: ১
কোনো অমুসলিমকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা যেভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রযোজ্য, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও প্রযোজ্য।
কারণ, বন্ধুত্ব হলো- আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসের জায়গা। যার থেকে স্পর্শকাতর, কঠিন মুহূর্তে পরামর্শ নেওয়া হয়। যার কাছে দুর্দিনে নিজের মূল্যবান গোপন সম্পদ অনায়েসে গচ্ছিত রাখা যায়। তাই তো আধুনিককালেও কোনো রাষ্ট্র তার মৌলিক চেতনা পরিপন্থী কাউকে বন্ধুরাষ্ট্ররূপে গ্রহণ করে না। আধুনিককালের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনো সরকার রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর পদে বিরোধী মতাদর্শের কাউকে বসায় না। এটা করা হয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে। সেভাবেই ইসলামও মুসলামানদের নিরাপত্তা, ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, খেলাফতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অমুসলিমকে বন্ধু বানাতে নিষেধ করেছে।
ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, খেলাফতের পতনের পেছনে যতগুলো কারণ সক্রিয় ছিলো- তার একটি হলো কোরআনের এ বিধানের লংঘন। অতীতে বিভিন্ন সময় খলিফারা বিভিন্ন লোভে বা চাপে পড়ে অমুসলিমকে খেলাফতের স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করত। তাদের কারণে খলিফা, খেলাফত ও মুসলিম জনসাধারণ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, বিপর্যস্ত হয়েছে।
ইসলাম অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিলেও তাদের সঙ্গে উদার, সদয় ও মানবিক আচরণকে হারাম করেনি, তাদের সঙ্গে ন্যায়ানুগ আচরণকে হারাম করেনি, তাদের প্রতি কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি ও অত্যাচারকে বৈধ করেনি। বরং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘মুসলিম অধ্যুষিত দেশের অধিবাসী অমুসলিম নাগরিককে যে মুসলিম কষ্ট দেবে কিয়ামতের দিন আমি সেই মুসলিমের বিপক্ষে বাদি হবো। আর যে মোকাদ্দামায় বাদি হবো তাতে জয়লাভ অবধারিত।’
তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে অত্যাচার করতে আমার পালনকর্তা আমাকে নিষেধ করেছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সাবধান! যে মুসলিম কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি অত্যাচারক করবে, কিংবা তার প্রাপ্য হ্রাস করে দেবে, তার ওপর তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেবে অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কোনো জিনিষ নেবে, কিয়ামতের দিন আমি সেই অমুসলিমের উকিল হবো।’
অন্য এক হাদিসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, অমুসলিম প্রতিবেশির জন্য প্রতিবেশিসুলভ হক বরাদ্দ থাকার স্বীকৃতি দিয়েছেন। অর্থাৎ কোনো মুসলিমের প্রতিবেশি যদি অমুসলিম হয় তবে একজন প্রতিবেশি যে সব হক লাভ করে সেও সেগুলো পাবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের বিচারের দৃষ্টান্তগুলোতে আমরা দেখতে পাই, অনেক মামলাতে তাদের রায় মামলার মুসলিমের পক্ষে না যেয়ে অমুসলিমের পক্ষে গেছে। অর্থাৎ তারা বিচারে মুসলিম বা অমুসলিম হিসেবে পক্ষ নেননি, বিপক্ষ হননি। বরং ন্যায় বিচার নিশ্চিৎ করেছেন, ন্যায়ের পক্ষ নিয়েছেন। ফলে অনেক সময়ই তাদের রায় মুসলিমের বিপক্ষে গেছে।
মোটকথা, অমুসলিমের ওপর কোনো অবিচার করা যাবে না, কোনো অত্যাচার করা যাবে না, কোনো অনাচার করা যাবে না, তার সম্পদ লুটপাট করা যাবে না, তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা যাবে না বরং অমুসলিমের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে, সদাচারণ করতে হবে, সে আর্তপীড়িত হলে তার সেবা-সহযোগিতা করতে হবে। আবার অমুসলিমকে মনের অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো যাবে না, তার সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক রাখা যাবে না।