মৌমাছি ও মধু আল্লাহর কুদরতের অপার নিদর্শন

  • মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মৌমাছি ও মধু আল্লাহর কুদরতের অপার নিদর্শন, ছবি: সংগৃহীত

মৌমাছি ও মধু আল্লাহর কুদরতের অপার নিদর্শন, ছবি: সংগৃহীত

চলতি রমজানের ১১তম তারাবিতে ১৪ নম্বর পারা অর্থাৎ সূরা হিজরের শুরু থেকে সূরা নাহলের শেষ পর্যন্ত পাঠ করা হবে। আজকের তারাবিতে অনেক বিষয়ের মধ্যে বিশেষভাবে থাকছে মৌমাছির জীবনাচার ও মধুর গুণের ওপর সারাংশমূলক আলোচনা।

এ প্রসঙ্গে সূরা নাহলের ৬৮ ও ৬৯ নম্বরে আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছির অন্তরে ইঙ্গিতে এ নির্দেশ দিয়েছেন, গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। অত:পর প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু আহার করো আর তোমার প্রতিপালক তোমার জন্য যে পথ সহজ করে দিয়েছেন সে পথ অনুসরণ করো। এর উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়। যাতে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য। অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।’

বিজ্ঞাপন

মহান আল্লাহ এ স্থানে মৌমাছি সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করেছেন। ১. মৌমাছির চাক বানানো, ২. কিছু আহরণ করা, ৩. সহজ পথে চলা, ৪. মধু তৈরি করা, ৫. মধু আরোগ্য হওয়া। আর এ পুরো আলোচনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ অর্থাৎ এ বিষগুলো নিয়ে চিন্তা করলে আল্লাহর অস্তিত্ব ও কুদরত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, আল্লাহর আনুগত্য করার অনুপ্রেরণা পাওয়া যাবে, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা বাড়বে।

মৌমাছি প্রধাণত দুই ধরনের বস্তু আহরণ করে। পরাগ ও রস। পরাগ হলো- ফুলের মধ্যে অবস্থিত শুকনো পাউডারের মতো উপাদান। এর রঙ ফুলের ওপর নির্ভর করে, ফুল ভেদে এর রঙের ভিন্নতা দেখা যায়। মৌমাছি ফুলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে তা সংগ্রহ করে। তারা বাম পায়ের মধ্যে ঝুড়ির মতো অংশে এই পরাগ সংগ্রহ করে, এগুলো প্রোটিনের অন্যতম উৎস। এগুলোকে মৌচাকে সঞ্চিত করে রাখা হয়। কর্মী মৌমাছিরা তাদের মাথা দিয়ে মৌচাকের ষড়ভুজাকৃতির কোষের মধ্যে ভালোভাবে প্রবেশ করিয়ে রাখে। আর রস হলো- ফুলের মধ্যে অবস্থিত গ্লুকোজ পূর্ণ তরল পদার্থ। মৌমাছি ফুল থেকে এই রস গ্রহণ করে মৌচাকে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় তারা ‘মধু পাকস্থলী’তে রাখে, তবে এখানে তা হজম হয় না। মৌমাছির দু’টি পাকস্থলী। একটিতে সে খায় এবং অপরটিতে সে সংরক্ষণ করে। ১ চা চামচ পরিমাণ মধু তৈরির রস সংগ্রহের জন্য ১২টা মৌমাছিকে প্রায় ২৬০০ ফুলের মধ্যে ঘুরতে হয়।

বিজ্ঞাপন

বাইরের মৌমাছিরা ফুল থেকে রস নিয়ে মৌচাকে আসলে বাসায় থাকা মৌমাছিরা তাদের থেকে মুখে করে সেই রস গ্রহণ করে। এরা আবার সেই রসের সঙ্গে নিজের নিজের শরীরের এক প্রকার পাচক রস মিশ্রিত করে। অত:পর এ মিশ্রণ মৌচাকের ষড়ভুজাকৃতির সুন্দর স্তরের সজ্জিত কক্ষে তারা জমা করে। অত:পর পাখার বাতাসে তারা এ মিশ্রণের পানি শুকাতে থাকে। শুধু ১৮ শতাংশের মতো পানি বাকি রেখে দেয়, এভাবেই তৈরি হয় মধু। মধু তৈরির পর চাকের প্রতিটি কক্ষ মোম দিয়ে আটকিয়ে দেয়। প্রতিটি মৌমাছি তাদের জীবনে মাত্র (১/১২ টেবিল চামচ) ১ টেবিল চামচের বারো ভাগের এক ভাগ মধু তৈরি করতে পারে।

মধুতে যেসব উপকরণ রয়েছে তন্মধ্যে প্রধান উপকরণ সুগার। সুগার বা চিনি আমরা অনেকই এড়িয়ে চলি, কিন্তু মধুতে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ এ দু’টি সরাসরি মেটাবলাইজড হয়ে যায় এবং ফ্যাট হিসেবে জমা হয় না। এতে আরও রয়েছে অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান। রয়েছে ভিটামিনের বিভিন্ন প্রকার। মধু এক ধরনের ওষুধ, যা পচন নিবারক (অ্যান্টিসেপটিক)। তাতে কোলেস্টেরলবিরোধী এবং ব্যাকটেরিয়াবিরোধী উপাদান রয়েছে।

সুস্থ-অসুস্থ যে কেউ মধু খেতে পারেন। বেশি খেতে চাইলে শর্করা জাতীয় খাদ্য কমিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত ও পরিমিত মধু সেবন করলে যেসব উপকার পাওয়া যায়, তা হলো-

হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। রক্তনালি প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে এবং হৃদপেশির কার্যক্রম বৃদ্ধি করে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দাঁতকে পরিষ্কার ও শক্তিশালী করে, দৃষ্টিশক্তি ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে, মধুর রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা- যা দেহকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের হাত থেকে রক্ষা করে।

মধু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও কোষকে ফ্রি রেডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এছাড়া নিয়মিত মধু সেবনে বার্ধক্য দেরিতে আসে, মধুর ক্যালরি রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়- ফলে রক্তবর্ধক হয়, যারা রক্ত স্বল্পতায় ভোগেন- বিশেষ করে নারীরা; তাদের জন্য নিয়মিত মধু সেবন অত্যন্ত ফলদায়ক।

এভাবে মধু মানবদেহের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।

মৌমাছির সুশৃঙ্খর সংঘবদ্ধ জীবন, দক্ষ নেতৃত্ব, একনিষ্ঠ আনুগত্য, কর্ম বণ্টন, অর্পিত দায়িত্ব পালন, বিশ্বস্ততা, বিচক্ষণতা, কর্মদক্ষতা, উদ্যমী মনোভাব, সুষ্ঠু পরিকল্পনা সব কিছুই অবাক করার মতো। কেউ যদি আল্লাহর কুদরত দেখে অবাক হতে চায়, মুগ্ধ হতে চায় তাহলে তাকে মৌমাছির জীবনাচার সম্পর্কে পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হবে। আর গভীর চিন্তার সঙ্গে এগুলো লক্ষ্য করলে তার ভেতরটা উদগ্রীব হয়ে উঠবে এর সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার সন্ধানে ব্রত হতে।