‘ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ নয়’
রমজানের ২২তম তারাবিতে তেলাওয়াত করা হবে ২৫তম পারা অর্থাৎ সূরা হামিম আস সাজদার ৪৭ নম্বর আয়াত থেকে সূরা আলজাসিয়ার শেষ পর্যন্ত। আজকের তারাবির তেলাওয়াতে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো- পিতৃপুরুষের ভুল অনুকরণের সমালোচনা।
এ প্রসঙ্গে এ তারাবিতে থাকছে, ‘বরং তারা বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথপ্রাপ্ত। এমনিভাবে আপনার পূর্বে আমি যখন কোনো জনপদে কোনো সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি এক পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছি।’ -সূরা যুখরুফ: ২২-২৩
মক্কার কাফেররা ফেরশতাদের আল্লাহর কন্যা জ্ঞান করে পূজা করত। যখন তাদের জিজ্ঞেস করা হতো, এরা যে আল্লাহর কন্যা তা তোমরা কিভাবে জানলে? আল্লাহর পাঠানো কোনো আসমানি কিতাবে কি তোমরা এ তথ্য পেয়েছ? আল্লাহ নিজে কি তোমাদের এ তথ্য প্রদান করেছেন? প্রশ্নের সঠিক ও যথার্থ উত্তর যখন তারা দিতে পারতো না, যুক্তিতে যখন তারা হেরে যেতো তখন তাদের উত্তর এটাই হতো যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এ মত ও পথের ওপর পেয়েছি। মহান আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন, শুধু মক্কার কাফেররাই নয় অতীতকালে যখনই কোনো নবী পাঠানো হয়েছে। আর উম্মত তাদের পাপ কাজের ব্যাপারে, শিরক ও কুফরের ব্যাপারে সঠিক কোনো জবাব দিতে পারেনি, কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি তখনই সেই সকল নবীর উম্মতরা তাদের নবীদের এ জবাব দিতো যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এ মত ও পথের ওপর পেয়েছি।
শিরক ও কুফরের ব্যাপারে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়ে পূর্বপুরুষদের মত ও পথের দোহাই দেওয়ার এ ঘৃণিত প্রবণতার সমালোচনা ও নিন্দা কোরআনে কারিমের আরও কয়েক স্থানে করা হয়েছে। যেমন-
‘আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সেই হুকুমেরই আনুগত্য কর যা আল্লাহতায়ালা নাজিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনও না, আমরা সে বিষয়েরই অনুসরণ করব, যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে দেখেছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানতো না, জানতো না সরল পথও। বস্তুতঃ এহেন কাফেরদের উদাহরণ এমন, যেন কেউ এমন কোনো জীবকে আহ্বান করছে যা কোনো কিছুই শোনে না, হাঁক-ডাক আর চিৎকার ছাড়া –বধির মূক এবং অন্ধ। সুতরাং তারা কিছুই বোঝে না।’ -সূরা বাকারা: ১৭০-১৭১
‘যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন তার বলে, আমাদের জন্য তা-ই যথেষ্ট, যারা ওপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ-দাদারা কোনো জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে?’ -সূরা মায়েদা: ১০৪
‘তারা যখন কোনো মন্দ কাজ করে, তখন বলে, আমরা বাপ-দাদাকে এমনটি করতে দেখেছি এবংআল্লাহও আমাদেরকে এ নির্দেশই দিয়েছেন। অথচ আল্লাহ মন্দ কাজের নির্দেশ দেন না। এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ কর যা তোমরা জানো না।’ -সূরা আরাফ:২৮
‘তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে দিতে এসেছো যাতে আমরা পেয়েছি আমাদের বাপ-দাদাদেরকে? আর যাতে তোমরা দু’জন এ দেশের নেতৃত্ব পেয়ে যেতে পার? আমরা তোমাদেরকে কিছুতেই মানব না।’ -সূরা ইউনুস:৭৮
‘যখন তিনি তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বললেন, এ মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ? তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে এদের পূজা করতে দেখেছি। তিনি বললেন, তোমরা প্রকাশ্য গোমরাহিতে আছে এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও।’ -সূরা আম্বিয়া:৫২-৫৪
‘যখন তার পিতাকে এবং তার সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা কিসের ইবাদাত কর? তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং সারাদিন এদেরকেই নিষ্ঠার সঙ্গে আঁকড়ে থাকি। ইবরাহিম বললেন, তোমরা যখন আহ্বান কর, তখন তারা শোনে কি? অথবা তারা কি তোমাদের উপকার কিংবা ক্ষতি করতে পারে? তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের পেয়েছি, তারা এরূপই করত। -সূরা শুআরা:৭০-৭৪
‘এমন লোকও আছে, যারা জ্ঞান, পথনির্দেশ ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহর সম্পর্কে বাকবিতণ্ডা করে। তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ করো, তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের ওপর পেয়েছি তারই অনুসরণ করব। শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে দাওয়াত দেয় তবুও কি?’ -সূরা লুকমান: ২০-২১
উপরোক্ত আয়াতগুলো এ কথার ওপর অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, পূর্বপুরুষদের অনুসৃত মত ও পথের স্বপক্ষে যদি কোরআন-সুন্নাহর সমর্থন ও প্রমাণ পাওয়া না যায়, তবে তা অনুসরণ করা যাবে না। কোরআন-সুন্নাহকে ছেড়ে দিয়ে যদি পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করা হতে থাকে তাহলে গন্তব্য হবে জাহান্নাম। তাহলে এ পথ হবে শয়তানের পথ।
ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এগুলোও কিন্তু পূর্বপুরুষদের, বাপ-দাদাদের অনুসৃত পথ। তাই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ততটুকই গ্রহণ করা যাবে যতটুকু কোরআন-সুন্নাহ অনুমোদন দেয়, যতটুকু কোরআন-সুন্নাহর মেজাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে, সংস্কৃতির অজুহাত দেখিয়ে একত্ববাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আচরণ করা যাবে না, ইসলামের শালীনতাবোধের বিপরীত কোনো পর্ব পালন করা যাবে না।
বিদআত ও কুসংস্কার সমাজে টিকে থাকে পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে। ধর্মের নামে কোনো আচার-আচরণ চর্চা করতে গেলে দেখতে হবে এর পেছনে কোরআন-সুন্নাহর সমর্থন ও অনুমোদন আছে কিনা। নাকি শুধুই বাপ-দাদার অনুকরণে করা হচ্ছে।
আবার কোরআন-সুন্নাহ থেকে গবেষণালব্ধ কোনো বিষয়ে যদি ইমাম ও ফকিহদের মাঝে মতপার্থক্য থাকে সেক্ষেত্রে কোনো এক ইমামের বা কোনো এক ফকিহের মত ও গবেষণাকে অনুসরণ করা উপরোক্ত আয়াতগুলোর নিন্দনীয় অনুসরণের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে না। কেনানা, আয়াতে সমালোচনা করা হয়েছে কোরআন-সুন্নাহকে বর্জন করার জন্য পূর্বপুরুষদের অনুসরণের। কিন্তু মাজহাবের অনুসরণের ক্ষেত্রেতো কোরআন-সুন্নাহকে বর্জন করার জন্য পূর্ববর্তী ইমামের মত গ্রহণ করা হচ্ছে না। বরং কোরআন-সুন্নাহকে অনুসরণ করার জন্য ব্যাখ্যা হিসেবে ইমামের মত গ্রহণ করা হচ্ছে। তাই মাজহাব অনুসরণের সঙ্গে এ সব আয়াতের কোনো সম্পর্ক নেই।