বেফাকের গঠনতন্ত্রে সংশোধন জরুরি



মুফতি মাহফূযুল হক
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের লোগো, ছবি: সংগৃহীত

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের লোগো, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশের কওমি মাদরাসাসমূহের সার্বিক মানোন্নয়ন এবং মাদরাসাগুলোকে বৃহৎ ঐক্যের আওতায় নিয়ে আসতে গঠিত হয় ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ। ’ বাংলায় ‘বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড’ আর সংক্ষেপে ‘বেফাক’ নামে এ বোর্ড বেশি পরিচিত।

১৯৭৮ সালে বেফাক প্রতিষ্ঠার পরপরই রচিত ও গৃহীত হয় বেফাকের মূল গঠনতন্ত্র। পরর্বতীতে ১৯৮০ সালের লালকুঠী কাউন্সিলে গৃহীত হয় ১ম সংশোধনী, একই সালের ৫ সেপ্টেম্বর গৃহীত হয় ২য় সংশোধনী, ১৯৮৫ সালে গৃহীত হয় ৩য় সংশোধনী, ১৯৯২ সালে গৃহীত হয় ৪র্থ সংশোধনী। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে গৃহীত হয় ৫ম সংশোধনী। এর পর দীর্ঘ একুশ বছরে আর গঠনতন্ত্রে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। তবে, বেফাকের একাধিক দায়িত্বশীল জানিয়েছেন, আবারও গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। এমতাবস্থায় বেফাকের সর্বশেষ গঠনতন্ত্রের আলোকে কিছু পর্যবেক্ষণ, সুপারিশ ও অভিমত পেশ করা হলো।

পর্যবেক্ষণ-১
বেফাক গঠনতন্ত্রের ‘সাংগঠনিক অবকাঠামো’ অধ্যায়ে লেখা আছে- ‘উক্ত প্রতিষ্ঠান সূচারূরূপে পরিচালনার জন্য সর্বমোট ৪টি মজলিস বা পরিষদ থাকবে। যথা- ১. মজলিসে উমূমী বা সাধারণ পরিষদ। ২. মজলিসে শূরা বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিষদ। ৩. মজলিসে আমেলা বা কার্যনির্বাহী পরিষদ। ৪. মজলিসে খাস।’

গঠনতন্ত্রে ‘মজলিসসমূহের দায়িত্ব ও অধিকার’ অধ্যায়ে লেখা আছে, ‘গ. মজলিসে আমেলা: মজলিসে আমেলা হল উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা শক্তি। এই মজলিসের দায়িত্ব নিম্নরূপ- ১. বেফাকের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ। ২. মজলিসে শূরা কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ ও অনুমোদিত সুপারিশমালা বাস্তবায়নের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।’

এ অধ্যায়ে আরো লেখা আছে: খ. মজলিসে শূরা: মজলিসে শূরা হবে নীতি নির্ধারণী উচ্চ ক্ষমতার অধিকারী মজলিস। তবে আইনগতভাবে এই মজলিস মজলিসে উমূমীর নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।’

এ অধ্যায়ে আরও লেখা আছে: ক. মজলিসে উমূমী: মজলিসে উমূমী অত্র প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বলে বিবেচিত হবে ‘

গঠনতন্ত্রের উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়- বেফাকের সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার ও বেফাককে প্রত্যক্ষ পরিচালনা করার দায়িত্ব হলো মাজলিসে আমেলার। আর শাব্দিক ভাবেও তা-ই বুঝে আসে। কেননা, এ নামের অর্থই হলো কার্যনির্বাহী কমিটি। গঠনতন্ত্রের আলোকে মজলিসে আমেলার ঊর্ধ্বতন কমিটির নাম মজলিসে শূরা (উপদেষ্টা পরিষদ) আর এর ঊর্ধ্বতন কমিটির নাম মজলিসে উমূমী (সাধারণ পরিষদ)।

একটি সংগঠনের, একটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতার জন্য, গতিশীলতার জন্য সেই সংগঠনের পরিচালনা করার, কার্য নির্বাহ করার, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদেরকে জবাবদিহিতার অধীনে রাখার কোনো বিকল্প নেই। এর যতটুকু বিচ্যুতি হবে প্রতিষ্ঠানের পথচ্যুতিও ঠিক ততটুকুই হবে। তাহলে বেফাকের স্বার্থে, হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার স্বার্থে, আগামী প্রজন্মের স্বার্থে অপরিহার্য ছিল মাজলিসে আমেলাকে বিশেষতঃ মাজলিসে আমেলার সভাপতি, মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষকে ঊর্ধ্বতন দু’টি কমিটির কঠোর জবাবদিহিতার অধীনে রাখা। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় যে, পুরো গঠনতন্ত্রের কোথাও মাজলিসে আমেলাকে কারও কাছে জবাবদিহি থাকতে বা করতে স্পষ্ট ভাষায় বাধ্য করা হয়নি।

গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট ভাষার আলোকে মজলিসে আমেলা জবাবদিহি করতে বাধ্য না থাকলেও সারা পৃথিবীর সাংগঠনিক রেওয়াজ ধর্তব্য হলে মজলিসে আমেলা তার ঊর্ধ্বতন কমিটি মজলিসে শূরার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। আবার গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি মোতাবেক মজলিসে শূরা কিন্তু তার ঊর্ধ্বতন কমিটি মজলিসে উমূমীর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো, অত্যন্ত কৌশলে এ গঠনতন্ত্র কার্যনির্বাহী কমিটিকে সকল নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রেখে বেফাকের অসীম ক্ষমতার মালিক করে দিয়েছে।

কেননা, এ গঠনতন্ত্রের ‘সাংগঠনিক কাঠামো’ অধ্যায়ে লেখা আছে: ‘মজলিসে আমেলার সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সহ-সভাপতিগণ পদাধিকার বলে শুরার সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সহ-সভাপতি গণ্য হবেন এবং আমেলার নাযেমে উমূমী ও সহকারী নাযেমে উমূমী পদাধিকার বলে শুরার নাযেমে উমূমী ও সহকারী নাযেমে উমূমী হবেন।’

উক্ত অধ্যায়ের মজলিসে উমূমী অনুচ্ছেদে লেখা আছে: ‘মজলিসে আমেলার সভাপতি এবং নাযেমে উমূমী (মহাসচিব) পদাধিকার বলে যথাক্রমে উক্ত পরিষদের সভাপতি ও মহাসচিব থাকবেন।’

এ উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে- কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ও মহাসচিব পদাধিকার বলে ঊর্ধ্বতন সকল কমিটিরই সভাপতি ও মহাসচিব। অধঃতন কমিটিতে আর ঊর্ধ্বতন কমিটিতে যখন একই ব্যক্তির অবস্থান তখন আর জবাবদিহিতার থাকে কী, নিয়ন্ত্রণেরইবা থাকে কী? নিজের কাছে নিজের জবাব তলব, নিজেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ? এ রকম বাস্তবতায় জবাবদিহিতার তো প্রশ্রই উঠেই না। বরং সুশাসন ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলারও কল্পনা করা তখন অন্যায় হয়ে যায়। এ রকম কৈফিয়তহীন, জবাবদিহিতামুক্ত, অনিয়ন্ত্রিত পদমর্যাদার দায়িত্বশীল দ্বারা কোনো প্রতিষ্ঠান গতিশীল ও স্বচ্ছ থাকতে পারে না, এটা অসম্ভব।

তাই বেফাকের গতিশীলতার জন্য, সুসাশন ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার, জবাবদিহিতার পরিবেশ বজায় রাখার জন্য গঠনতন্ত্রের এ পদাধিকার বাতিল করতে হবে। প্রতিটি মজলিসের দায়িত্বশীল আলাদা ব্যক্তি হতে হবে। একই ব্যক্তি মজলিসে আমেলার, মজলিসে শূরার, জেলা কমিটির সদস্য হতে পারবে না। একই ব্যক্তি সাংগঠনিক অবকাঠামোর সকল বা একাধিক পরিষদের দায়িত্বশীল হতে পারবে না।

পর্যবেক্ষণ- ২
সুশাসন, গতিশীলতা, জবাবদিহিতা ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা জন্য অপরিহার্য হলো- প্রতিষ্ঠানকে অনাত্মীয়করণ রাখা। সাহাবায়ে কেরামও আত্মীয়করণকে ঘৃণা করতেন। অস্বীকার করতেন। আমাদের নিকটতম অতীতের পূর্বসূরি মনীষীদের মধ্যেও অনাত্মীয়করণের নজির অনেক। দেশে অফিস আছে বিদেশি এমন কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমরা জানি, যেখানে বর্তমানে চাকুরিরত কোনো স্টাফেরই নিকটতম আত্মীয়ের নতুন নিয়োগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

কিন্তু বেফাক গঠনতন্ত্রে নিন্দিত আত্মীয়করণ প্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে কেউ কোনোভাবে বেফাকে পদ পেলে সেই সুযোগে প্রভাব খাটিয়ে নিজের আত্মীয়দেরও পদায়নের চেষ্টায় নেমে পড়েন। তাই গঠনতন্ত্র সংশোধন করে আত্মীয়করণকে গঠনতান্ত্রিকভাবেই নিষিদ্ধ করতে হবে। একজন ব্যক্তি বেফাকের যেকোনো পরিষদের সদস্য বা দায়িত্বশীল থাকা অবস্থায় তার কোনো স্বজন বা আত্মীয় কোনো পরিষদের সদস্য বা দায়িত্বশীল হতে পারবে না।

পর্যবেক্ষণ- ৩
গঠনতন্ত্রের ‘সাংগঠনিক অবকাঠামো’ অধ্যায়ের ‘মজলিসে শূরা’ অনুচ্ছেদে লেখা আছে: ‘এর সদস্যগণ মজলিসে উমূমীর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সাধারণ সদস্য থেকে নির্বাচিত হবেন।’

উক্ত অধ্যায়ের ‘মজলিসে আমেলা’ অনুচ্ছেদে লেখা আছে: ‘মজলিসে আমেলার সদস্য নির্বাচন ও কর্মকর্তাগণের পদ বিন্যাস মজলিসে উমূমীর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে।’

গঠনতন্ত্রের এ উদ্ধৃতিগুলোতে সাধরণ সদস্যদের মতকে মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মত জানার ও তা নিরুপণের সুনির্দিষ্ট কোনো পথ ও পদ্ধতি নির্ধারণ না করায় এ গঠনতন্ত্র সাধারণ সদস্যদের মতকে সুকৌশলে কার্যতঃ চরমভাবে অবমাননা করা হয়েছে। প্রভাবশালীদের কাছে বেফাককে জিম্মি করে রাখার পথ উন্মুক্ত করে রেখেছে। প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেট ও প্রভাব প্রান্তিক সাধারণ সদস্যদের মত প্রকাশ হতে দেয় না। কোনো এক প্রভাবশালী কাউন্সিলে দাঁড়িয়ে পূর্ব পরিকল্পিত ও সাজানো প্রস্তাব উত্থাপন করে সেক্ষেত্রে সদস্যদের অমত থাকলেও পরিবেশের চক্ষুলজ্জায় তা আর ব্যক্ত করার সুযোগ থাকে না।

তাই সাধারণ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ট মত স্পষ্টভাবে জানার জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ব্যালেটের মাধ্যমে মত গ্রহণের বাধ্যকতা আরোপ করতে হবে।

পর্যবেক্ষণ- ৪
গঠনতন্ত্রের ‘সাংগঠনিক অবকাঠামো’ অধ্যায়ের ‘জেলা ও উপজেলা কমিটি’ অনুচ্ছেদে লেখা আছে: ‘কেন্দ্রীয় কমিটি জেলা কমিটি গঠন করবে এবং জেলা কমিটি উপজেলা কমিটি গঠন করবে।’ আবার উক্ত অধ্যায়ের ‘মজলিসে শূরা’ অনুচ্ছেদে লেখা আছে: ‘প্রতি জেলার অন্তত ১ জন প্রতিনিধি (জেলা সভাপতি/সেক্রেটারী) শূরার সদস্য হবেন।’

আবার গঠনতন্ত্রের ‘মজলিসসমূহের দায়িত্ব ও অধিকার’ পরিচ্ছেদের ‘মজলিসে শূরা’ অনুচ্ছেদে লেখা আছে-
১. বেফাকের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং তার উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অত্র প্রতিষ্ঠানের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গঠনতন্ত্রের আলোকে নীতি নির্ধারণ ও কর্মসূচী প্রণয়ন।

২. মজলিসে আমেলাকে কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য অনুপ্রেরণা ও দিক-নির্দেশনা দান।
৩. মজলিসে আমেলার পক্ষ থেকে পেশকৃত উন্নয়ন পরিকল্পনা, প্রস্তাবাদী ও সুপারিশমালা বিবেচনা ও মঞ্জুরি দান।
৬. প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং শৃংখলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৯. বেফাকের কোনো বিভাগে জটিলতা দেখা দিলে তা নিরসনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ।’

উক্ত উদ্ধৃসমূহকে একত্রিত করলে ফল দাঁড়ায় অধঃতন কমিটি তার ঊর্ধ্বতন কমিটির ৬৪ জন সদস্য মনোনীত করছে। চরম অবাক করার ব্যাপার হলো- জেলা কমিটি গঠন করার নামে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি মূলতঃ তাদেরই মনোনীত করছে যারা তাদের কাজ দেবে, নির্দেশনা দেবে, তাদের সকল কাজের অনুমোদন দেবে, মঞ্জুরি দেবে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে, তাদের মীমাংসা করবে। তাই মানবীয় দুর্বলতায় খুব স্বাভাবিকভাবেই এ গঠনতন্ত্রের আবশ্যম্ভাবী ফল হলো- এ গঠনতন্ত্রের সংগঠনে ও প্রতিষ্ঠানে কোনো শৃঙ্খলা থাকবে না, জবাবদিহিতা থাকবে না, সুশাসন থাকবে না, গতিশীলতা থাকবে না। শুধু থাকবে দুর্নীতি, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা, স্থবিরতা ও সকল ধরণের বিশৃঙ্খলা।

তাই গঠনতন্ত্র থেকে ‘কেন্দ্রীয় কমিটি জেলা কমিটি গঠন করবে এবং জেলা কমিটি উপজেলা কমিটি গঠন করবে।’ এ বাক্য বিলুপ্ত করতে হবে এবং গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জেলা কমিটি ও উপজেলা কমিটি গঠনের দায়িত্ব ও অধিকার দিতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলার বেফাকভূক্ত মাদরাসার মুহতামিমদেরকে। যারা পদাধিকার বলে বেফাকের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্থায়ী কমিটি মজলিসে উমূমীর সদস্য। এবং অবশ্যই তা করতে হবে ব্যালেটের মাধ্যমে। জেলা ও উপজেলা কমিটিতে এমন কাউকে নির্বাচিত করা যাবে না যিনি নিজে বা যার কোনো আত্মীয়-স্বজন পূর্ব থেকেই বেফাকের মজলিসে আমেলার অথবা মজলিসে শূরার সদস্য আছেন অথবা পরিচালক বা মহাপরিচালক পদে কর্মরত আছেন।

পর্যবেক্ষণ- ৫
একজন অক্ষম ব্যক্তি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে না, পারবে না- এটা খুব সহজ কথা। অক্ষমতার অনেকগুলো কারণের মধ্যে খুবই সাধারণ একটা কারণ অতি বার্ধক্য। তাই বেশি বুড়োদের ওপর কাজ অর্পণ করা যায় না, করতে হয় না এ কথা প্রাথমিকের শিশুরাও বুঝে। বুড়ো দাদুকে আসতে-যেতে সালাম করতে হয়, তার সেবা করতে হয়, তার দোয়া নিতে হয় কিন্তু নাতির বিয়ের অনুষ্ঠানের ভার বুড়ো দাদুকে দেওয়া যায় না। একটি স্পষ্ট ও চূড়ান্ত সত্যকথা বেফাকের সভাপতি, মহাসচিব পদগুলো সম্মাননা নয়। এগুলো কাজ, কাজ আর কাজ। অনেক কাজ। পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের আসনে যদি অতি বুড়োকে রাখা হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, লুটপাট তো হবেই হবে।

বেফাকের গঠনতন্ত্রে এ সমস্যার সুস্পষ্ট কোনো সমাধান নেই। বেফাক গঠনতন্ত্র পড়ে আমরা সীমাহীন আশ্চর্য হলাম, সুস্পষ্ট সমাধান তো দূরের কথা অস্পষ্ট সমাধানও এ গঠনতন্ত্রে নেই। সদস্য পদ বিলুপ্তির অধ্যায়ে বিলুপ্তির ৪টি কারণ বলা হয়েছে। ৩ মিটিংয়ে অনুপস্থিত, আদর্শ বিরোধী কর্মকাণ্ড, পদত্যাগ, মৃত্যু। কিন্তু বিলুপ্তির সাধারণ কারণ যা প্রায় সকল সংবিধান ও গঠনতন্ত্রে থাকে, পাগল হওয়া, দায়িত্ব পালনে শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়া এগুলো বেফাক গঠনতন্ত্রে নেই। তার মানে সদস্য পদ বা দায়িত্বশীল মনোনীত হওয়ার পর সে পাগল হয়ে গেলেও, বুড়ো হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেও, বুড়ো হয়ে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেললেও সে বেফাকের সদস্য বা দায়িত্বশীল থাকবেন, যতক্ষণ না তিনি না মরেন। যারা নিজেরা চলতে পারে না, তারা একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান কিভাবে চালাবে? যারা সংসার চালাতে আনফিট তারা জাতীয় প্রতিষ্ঠান কিভাবে ফিট হয়। বয়সের কোনো সীমানা গঠনতন্ত্রে না থাকায় অচল বুড়োরা দায়িত্বে আসছে বা দায়িত্ব পালন করতে করতে অচল হয়ে পরলেও দায়িত্বে থেকে যাচ্ছে। আমরা বুড়োদের কাজ দিয়ে তাদের ওপর জুলুম করতে চাই না। তারা খানকায় বসে আমাদের দোয়া দেবেন, দরসে বসে আমাদের সনদ দেবেন। এতে তাদেরও কল্যাণ, জাতিরও কল্যাণ। বার্ধক্য দুর্বলতার নিশ্চিত একটি উপলক্ষ্য। আবার সবার বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা অক্ষমতা একই বয়সে দেখা দেয় না। আবার আইন তো আলাদা আলাদা করা হয় না। তাই সমাজের মানুষের গড় সক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই দায়িত্ব সমাপ্তির নির্দিষ্ট একটি বয়সের আইন, ধারা গঠনতন্ত্রে থাকা অপরিহার্য।

পর্যবেক্ষণ- ৬
গঠনতন্ত্রের ‘বেফাক-এর বিভাগসমূহ’ পরিচ্ছেদে লেখা আছে: ‘বেফাকের নির্বাহী পরিষদের নাযেমে উমূমী বা মহাসচিব পদাধিকার বলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তবে, যিনি মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকবেন তার সার্বক্ষণিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ জন্য তিনি নির্ধারিত স্কেলে বেতন ভাতা ভোগ করবেন।’

মহাসচিব হলো সাংগঠনিক সম্মানিত সদস্য পদ। যিনি মজলিসে আমেলার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এ পদে আসতে হয় মজলিসে উমূমীর মতের ভিত্তিতে ৫ বৎসরের জন্য। আর মহাপরিচালক হলো বেতভুক্ত চাকুরি পদ। যাকে মজলিসে আমেলা বেতনের চুক্তিতে নিয়োগ দান করে। তার মানে মহাসচিব হলেন মহাপরিচালকের নিয়োগকর্তা। আর মহাপরিচালক হলেন মহাসচিব থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী। গঠনতন্ত্রর উক্ত উদ্ধৃতিতে নিয়োগকর্তা আর নিয়োগপ্রাপ্ত একই ব্যক্তি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। শাসক ও শাসিত একই ব্যক্তিকে বানানো হয়েছে। শ্রম বিক্রেতা আর শ্রম ক্রেতা একই ব্যক্তি হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এটা বাস্তবতায়, যুক্তিতে, ফলাফলে হাস্যকর। আর তিক্ত হলেও বলতে হবে, নির্ধারিত উচ্চ স্কেলের বেতনের মোহে প্রতিটি মহাসচিব নিজেকেই মহাপরিচালক বানাবেন। আর এর আবশ্যম্ভাবি পরিণতিতে মহাপরিচালকের সকল চলবে শামুক গতিতে খামখেয়ালি মতে। তাই গঠনতন্ত্র থেকে এ উদ্ধৃতি বিলুপ্ত করতে হবে।

পর্যবেক্ষণ- ৬
গঠনতন্ত্রের ‘কার্যকাল’ পরিচ্ছেদে লেখা আছে: ‘সকল মজলিসেরই কার্যকাল হবে ৫ (পাঁচ) বৎসর।’ যে সুস্থ চিন্তা ও সতর্ক মনোভাব থেকে এ সিদ্ধান্ত গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেই চিন্তা ও মনোভাবের পূর্ণতার জন্য আবশ্যক ছিল এ সিদ্ধান্তকেও অন্তর্ভুক্ত করা যে, একই ব্যক্তি একই পরিষদের একই পদের জন্য দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হতে পারবে না।

সংশোধনী প্রস্তাব- ১:
কোনো একই ব্যক্তি উপজেলা কমিটি, জেলা কমিটি, মজলিসে আমেলা, মজলিসে শূরার মধ্য থেকে একাধিক কাঠামোর সদস্য বা দায়িত্বশীল হতে পারবে না। অধঃতন মজলিসের দায়িত্বশীলরা ঊর্ধ্বতন মজলিসের মিটিংয়ে নিছক তলবি হলে থাকতে পারবে। তা-ও মত প্রদানের জন্য নয়, ভোট প্রদানের জন্য নয়। নিছক কাজের কৈফিয়ত ও জবাব দেওয়ার জন্য।

সংশোধনী প্রস্তাব- ২:
মজলিসে উমূমীর সভাপতি, সচিব, সহ-সভাপতি, সহ-সচিব সাধারণ সদস্যদের থেকে পৃথকভাবে নির্বাচিত করতে হবে। অন্যকোনো পরিষদের দায়ত্বশীলরা মজলিসে উমূমীর দায়িত্বশীল হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবে না।

সংশোধনী প্রস্তাব- ৩:
বেফাকের (মজলিসে উমূমী ব্যতীত অন্য) যেকোনো পরিষদের সদস্যপদ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কোনো নিকটাত্মীয় অন্যকোনো পরিষদের সদস্য বা দায়িত্বশীল হতে পারবে না। এমনকি জেলা-উপজেলা কমিটিরও না। পরিচয় গোপন রেখে সদস্য পদ গ্রহণ করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা শুরু থেকেই বাতিল ও অবৈধ গণ্য হবে।

সংশোধনী প্রস্তাব- ৪:
মজলিসে উমূমী, মজলিসে শূরা, মজলিসে আমেলা, জেলা কমিটি ও উপজেলা কমিটির দায়িত্বশীল মনোনয়নের জন্য কাউন্সিল করতে হবে মাজলিসে উমূমীর সদস্যদের গোপন ব্যালেটের মাধ্যমে। কাউন্সিলর জন্য নির্বাচন উপকমিটি গঠন করতে হবে। নির্বাচনের শরিয়তসম্মত নীতিমালা তৈরি করতে হবে। স্বচ্ছ ব্যালেট বক্সে মাজলিসে উমূমীর সদস্যদের গোপন ব্যালেটে সবার সামনে নির্বাচন চলবে। ব্যালেট গণনা করে নির্বাচিত হবে সকল পরিষদের দায়িত্বশীল।

সংশোধনী প্রস্তাব- ৫:
মজলিসে আমেলার কোনো সদস্যের অথবা দায়িত্বশীলের বয়স ৬৫ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তিনি দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবেন, সদস্য থাকবেন না। দায়িত্বের ক্ষেত্রে পরবর্তী সহকারী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৩ মাসের জন্য উক্ত পদে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল হয়ে যাবেন। ৩ মাসের মধ্যে মাজলিসে উমূমীর জরুরি অধিবেশন উক্ত শূন্য পদের নিয়মিত দায়িত্বশীল নির্বাচন করবে।

সংশোধনী প্রস্তাব- ৬:
যেকোনো পরিষদের যেকোনো সদস্য বা দায়িত্বশীল পাগল হয়ে গেলে, অসুস্থতাজনিত কারণে অক্ষম হয়ে গেলে মজলিসে শূরার (প্রয়োজনে জরুরি) অধিবেশন তাকে সদস্য পদ থেকে, দায়িত্ব থেকে মুক্ত ঘোষণা করবে এবং পরবর্তী ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল মনোনীত করবে। এবং এর পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে মাজলিসে উমূমীর (প্রয়োজনে জরুরি) অধিবেশন উক্ত শূন্য পদের নিয়মিত দায়িত্বশীল নির্বচান করবে।

সংশোধনী প্রস্তাব- ৭:
মহাসচিব ও মহাপরিচালক অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি হতে হবে।

সংশোধনী প্রস্তাব- ৮:
একই ব্যক্তি একই পরিষদের একই পদের জন্য দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হতে পারবে না।

সংশোধনী প্রস্তাব- ৯:
প্রতিটি জেলার বেফাকভূক্ত মাদরাসাসমূহের মুহতামিমদের ব্যালেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জেলা কমিটি এবং উপজেলার বেফাকভূক্ত মাদরাসাসমূহের মহতামিমদের ব্যালেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উপজেলা কমিটি গঠন হবে।

সংশোধনী প্রস্তাব- ১০:
বেফাকের লক্ষ্য-উদ্দেশের কিছু ধারা আন্দোলনমুখী, বিভাগসমূহের কিছু বিভাগ শিক্ষা সংক্রান্তের বাইরে। ১৯৭৮ সালে বেফাক প্রতিষ্ঠার সময় আলেমদের ভিন্ন কোনো সংগঠন, ফোরাম ছিল না। তাই তখনকার প্রেক্ষিতে এগুলো ঠিক ছিল। কিন্তু এখন বহু সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, ফোরাম হয়েছে। তারা সেগুলো করছে। আর এগুলো একটি শিক্ষা বোর্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণও নয়। তাই বেফাকের জন্য শিক্ষা বোর্ডের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকাই উচিৎ। সব ভালো কাজ একই ব্যানার থেকে হওয়া অনিরাপদ ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপদ্ধতি। অতএব গঠনতন্ত্রের লক্ষ্য উদ্দেশ্য থেকে ৫ নম্বরের এবং বিভাগসমূহ থেকে ৫, ৬ ও ১০ নস্বরের বিলুপ্তি জরুরি হয়ে পড়েছে।

মুফতি মাহফূযুল হক: কওমি মাদরাসার শিক্ষক।

**প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বার্তা২৪.কম জনকল্যাণে সম্পৃক্ত সব বিষয়ে সব ধরনের আলোচনা-সমালোচনা সাদরে গ্রহণ ও উৎসাহিত করে।

   

মসজিদের নগরী এখন মসজিদের দেশে পরিণত হয়েছে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজের অনাচার দূর করা সম্ভব। বিশেষ করে দুর্নীতি, মাদকাসক্তিসহ সব সমস্যা দূরীকরণে সামাজিক সংঠনগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিষ্ঠার সঙ্গে আরও ব্যাপকভাবে কাজ করা দরকার।

বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) রাজধানীর কাকরাইলস্থ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তারা আরও বলেন, উগ্রবাদীদের টার্গেটে যখন বাংলাদেশ, তখন এগিয়ে এসেছেন আলেম-উলামা এবং সংগঠনসমূহ। একসময় ঢাকা শহরকে মসজিদের নগরী বলা হতো। এখন সেটা ছাপিয়ে পুরো বাংলাদেশ মসজিদের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর কারণে।

ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান উপদেষ্টা ধর্মবিষক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এমপিকে পূর্ণ মন্ত্রী, প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মূখ্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপিকে পরপর তিনবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় সংগঠনের বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি মাওলানা ওমর ফারুকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুফতি আবুল বাশার নুমানি, মাওলানা মুজিবুর রহমান, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল হামিদ জমাদ্দার, ডি আইজি নাফিউর রহমান, মুফতি মুনিরুল ইসলাম এবং মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রমুখ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে এটি আলোচনায় আসে।

২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বিশ্বজয়ী হাফেজদের সংবর্ধনা ও জাতীয় হিফজুল কুরআন প্রতিযোগীতা’ আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফাউন্ডেশনটি ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে।

২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম দেশসেরা হাফেজদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।

কাজের ধারাবাহিকতায় ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তা প্রদান, ঢাকার মিরপুরে পুলিশ কনভেনশন হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সচেতনতামূলক সেমিনার, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘এডিস মশা ও ডেঙ্গু বিস্তাররোধে করণীয়’ সম্পর্কে ইমাম-খতিবদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন ছাড়াও সারাদেশে ধর্মীয় ও সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

;

রমজানে উমরাকারীর সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

  • Font increase
  • Font Decrease

সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা ও মদিনায় এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। দৃষ্টি যতদূর যায় শুধুই মানুষের ভিড়। তাদের কেউ ইহরাম পরিহিত, কেউ স্বাভাবিক পোষাকে। তবে সবার লক্ষ্য এক জায়গা- মসজিদে হারাম।

সোমবার (২৫ মার্চ) এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়া জানিয়েছে, সৌদি আরবের হজ ও উমরা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পবিত্র এই মাস শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৮০ জন মুসল্লি উমরা পালন করেছেন।

সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, এর আগে এত বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এভাবে ভিড় করেননি। তাদের আশা আগামী ১৫ দিনে এই সংখ্যা ২ কোটি পার হয়ে যাবে।

প্রতিবেদন অনুসারে রমজান মাস শুরুর পর থেকে ৭২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৪ জন উমরা সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে দেশটিতে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৬ জন অবস্থান করছেন।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, স্থলপথে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উমরাযাত্রী সৌদি আরব এসেছেন। এরপর যথাক্রমে আকাশপথ ও সমুদ্রপথে এসেছেন। স্থলপথে ৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৬ জন আগমন করেছেন। আর আকাশপথে সাত লাখ ৯৮৩ জন এবং সমুদ্রপথে ৫৪ হাজার ১৪১ জন এসেছেন। রমজান মাসে পবিত্র মসজিদে হারামে ভিড় নিয়ন্ত্রণে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে উমরা পালন নিশ্চিত করতে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সৌদি আরব।

বিশেষ করে নুসুক অ্যাপের মাধ্যমে চলতি রমজানে উমরা পালনের কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বারের মতো অনুমতি পাননি। অ্যাপে আবেদন করলে একটি বার্তা ভেসে ওঠে। তাতে লেখা থাকে, ‘অনুমতি প্রদান ব্যর্থ হয়েছে। সবাইকে সুযোগ দিতে রমজানে দ্বিতীয়বার কেউ উমরা করতে পারবেন না।’

অন্য আরেক নির্দেশনায় পবিত্র কাবাঘরের প্রাঙ্গণ তথা মাতাফে নামাজ না পড়ে মসজিদে হারামে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে। যেন ওই সময় উমরাযাত্রীরা তওয়াফ করতে পারেন। এ ছাড়া রমজান মাসে একবারের বেশি উমরা পালনে বারণ করাসহ মক্কার বাসিন্দাদের মসজিদে হারামে ভিড় না করে আশপাশের মসজিদে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে এক কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মুসলিম উমরা পালন করেছে, যা ছিল সৌদি আরবের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যা।

;

শিক্ষাদানের শর্তে যে যুদ্ধের বন্দিরা মুক্তি পায়



মাওলানা সাইফুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বদর যুদ্ধে বিপুলবৈভব কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভাবনীয় বিজয় অর্জিত হয়। এই যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হয় এবং সমপরিমাণ ব্যক্তি বন্দি হয়। যুদ্ধ শেষে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছার পর সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ওরা তো চাচাতো ভাই এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন। আমার মত হলো, ওদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোক। এতে অর্জিত সম্পদ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তিতে পরিণত হবে। আর এমনও হতে পারে, আল্লাহতায়ালা তাদের হেদায়েত দেবেন এবং তারা একসময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ভিন্ন মত দিলেন। তিনি বললেন, কুরাইশ যোদ্ধাদের হত্যা করা হোক, যেন ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের সাহস কেউ না পায়। এ ছাড়া এ যুদ্ধবন্দিরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তাদের অনুপস্থিতি অবিশ্বাসী শিবিরকে দুর্বল করে দেবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা হজরত ওমরের সিদ্ধান্তটিই অধিক সঠিক ছিল বলে জানিয়ে দেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইশারা করে বললেন, আমার কাছে ওদের আজাব এই গাছের চেয়ে নিকটতর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। -তারিখে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওজি, পৃষ্ঠা ৩৬

তবে আল্লাহতায়ালা ফিদইয়া গ্রহণের সিদ্ধান্তের বৈধতা দেন এবং প্রদেয় মুক্তিপণকে মুসলিমদের জন্য হালাল ঘোষণা করেন। তবে আল্লাহতায়ালা এ জন্য করেছেন যে তারা শুধু যুদ্ধবন্দি ছিল না; বরং তারা ইসলাম, মুসলমান ও মানবতার বিরোধী অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।

যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে নেওয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশা দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন- মক্কাবাসী লেখাপড়া জানত। পক্ষান্তরে মদিনায় লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ফলে যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ্য নেই এবং লেখাপড়া জানে, তাদের সুযোগ দেওয়া হলো যে তারা মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার পর শিক্ষক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েকজন বন্দিকে বিশেষ দয়া করায় তাদের কাছ থেকে ফিদইয়া গ্রহণ করা হয়নি, এমনিতেই মুক্তি দেওয়া হয়। তারা ছিল মোত্তালিব ইবনে হানতাব, সাঈফি ইবনে আবু রেফায়া ও আবু আযযা জুমাহি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন যে তিনি নবীনন্দিনী হজরত জয়নব (রা.)-র পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।

এর কারণ ছিল যে হজরত জয়নব (রা.) আবুল ইবনে আসের ফিদইয়া হিসেবে কিছু সম্পদ পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হারও ছিল। হারটি হজরত খাদিজা (রা.) হজরত জয়নব (রা.)-কে আবুল আসের ঘরে পাঠানোর সময় উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তা দেখে অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন এবং আবেগে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি আবুল আসকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহাবাদের মতামত চান। সাহাবারা প্রিয় নবী (সা.)-এর এই প্রস্তাব সশ্রদ্ধভাবে অনুমোদন করেন। অতঃপর মহানবী (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে তিনি হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় আসার সুযোগ করে দেবেন। স্বামীর অনুমতি পেয়ে জয়নব (রা.) মদিনায় হিজরত করেন।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা এবং অন্য একজন আনসারি সাহাবিকে মক্কায় প্রেরণ করেন। তাদের বলা হয়, তোমরা মক্কার উপকণ্ঠ অথবা জাজ নামক জায়গায় থাকবে। হজরত জয়নব (রা.) তোমাদের কাছ দিয়ে যখন যেতে থাকবেন, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। এই দুজন সাহাবি মক্কায় গিয়ে হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় নিয়ে আসেন। হজরত জয়নব (রা.)-এর হিজরতের ঘটনা অনেক দীর্ঘ এবং মর্মস্পর্শী।

;

ইতিহাস বদলে দেওয়া বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট



মাওলানা আবদুল জাব্বার, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ বদর। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে মুখোমুখি হয় মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। বদর যুদ্ধে আল্লাহতায়ালা অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। অস্তিত্বের সংকট থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেন।

৬২৪ খ্রিস্টাব্দ তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান সংঘটিত হয়েছিল ইসলামে চিরস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় বদর যুদ্ধ। এটি ছিল সত্য ও মিথ্যার, হক ও বাতিলের, মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যকার ঐতিহাসিক যুদ্ধ, ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। এই বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবিব নিরস্ত্র মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সঙ্গীদের বিজয়ী করেছিলেন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার মোকাবেলায়।

ঘটনার সূত্রপাত
মদিনায় বইতে থাকা ইসলামের বসন্তের হাওয়া মক্কার কাফেরদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। না জানি কখন এই হাওয়া দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়ে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিংবা তাদের ব্যবসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা শামে গিয়েছিল। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল ৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধার পাহারায় এক হাজার মালবাহী উটের একটি বাণিজ্যিক বহর।

বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল মুসলমানরাও। তাই যখন তারা শাম থেকে ব্যবসা শেষে অস্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরছিল, তখন তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত হলো। মুসলমানদের আত্মরক্ষার্থে হামলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠায়। তবে খবরটি ছিল, মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। অথচ মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আবু সুফিয়ানকে আটকানো।

এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তা ছিল নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য অহি লাভ ও মক্কাবাসীর ক্ষোভ ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা হয়, মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন এবং রাসুল (সা.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কাফেরদের অশুভ বাসনা।

যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মহান আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’- সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যঃপ্রসূত মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামি রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই হয়েছিল। এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বদর যুদ্ধ আরবের বহু মানুষের হৃদয়ের সংশয় দূর করে দেয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণের সৎসাহস খুঁজে পায়। এ ছাড়া অসম শক্তির বিরুদ্ধে এই অসাধারণ বিজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।

আরবের অমুসলিমদের ওপরও বদর যুদ্ধের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতনামা আরব বীর। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ নেতাদের করুণ মৃত্যু তাদের হৃদয়াত্মাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাদের চোখ থেকে অহমিকার পর্দা সরে যায়। কারণ সমকালীন ইতিহাসে কুরাইশ গোত্রের এমন বিপর্যয় আরবরা দেখেনি।

এ ছাড়া বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কুরাইশদের অবাধ বাণিজ্য এবং আরবের অন্যান্য গোত্রের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ করে দেয়। মদিনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুণ্ঠনের যে ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল- যার পেছনে কুরাইশ নেতাদের সহযোগিতা ও প্রশ্রয় ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে মদিনা ও আশপাশের সর্বস্তরের মানুষ। তারা স্বাগত জানায় সত্যপক্ষের এই মহান বিজয়কে।

;