ত্যাগের বার্তায় উদ্ভাসিত ঈদুল আজহা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ত্যাগের বার্তায় উদ্ভাসিত হোক ঈদুল আজহা, ছবি: বার্তাগ্রাফিক্স

ত্যাগের বার্তায় উদ্ভাসিত হোক ঈদুল আজহা, ছবি: বার্তাগ্রাফিক্স

মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে প্রতিটি ঈদ বহুমাত্রিক ব্যাঞ্জনায় উজ্জ্বলতর। রোজার কৃচ্ছ্রব্রত শেষে আসে ঈদুল ফিতর আর ত্যাগের মহিমা ও বার্তায় উদ্ভাসিত হয়ে এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা, যার আরেক নাম ‘কোরবানি ঈদ।’

‘কোরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে আগত এবং ফার্সি, উর্দু ও বাংলায় বহুল ব্যবহৃত। আরবি পরিভাষায় কোরবানিকে ‘নুসুক’ও বলা হয়। শাব্দিকভাবে যার অর্থ হলো- নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজের আত্মত্যাগের মাঝেই নিহিত আছে কোরবানির মূল তাৎপর্য।

বিজ্ঞাপন

ফলে পশু জবেহ করে যে কোরবানি ঈদ উৎসব পালন করা হয়, তার মর্মার্থ অনেক গভীরে। কেবল পশু জবাই করলেই স্রষ্টার প্রতি প্রেমময় ত্যাগ প্রকাশিত হয় না, নৈকট্য লাভও সম্ভব হয় না। জাগতিক লোভ, লালসা, অহংবোধ, হিংসাতে অন্ধ থাকলে আত্মত্যাগ অসম্ভব। অসম্ভব স্রষ্টার নৈকট্য লাভ। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের রিপুকে নিধন করাও কোরবানির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।

পাপ ও পূণ্যের দোলাচলে প্রবহমান মানুষের জীবনে শয়তান ও রিপু বা নফসের প্ররোচণাকে পরাজিত করে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় অপকর্মকে হনন করাও এক মহত্তম কোরবানি। তাওবার মাধ্যমে পাপ থেকে পরিশুদ্ধি অর্জন করে একমাত্র স্রষ্টার জন্য যাবতীয় ত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে শুভ্রতায়, পবিত্রতায়, নিষ্ঠায়, আনুগত্যে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করাই কোরবানির মূল লক্ষ্য। কেননা, পবিত্র কোরআনের সূরা হজের ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পশুগুলোর গোশত কিংবা রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের মনের তাকওয়া (খোদাভীতি)।'

বিজ্ঞাপন

অতএব, রিপুর তাড়না, অহমিকা ও আমিত্ববোধকে বির্সজনের মধ্য দিয়ে স্রষ্টার প্রতি আন্তরিক ও শুদ্ধতম আত্মসমর্পণ করার শিক্ষাই কোরবানির মূল চেতনা। পবিত্র হাদিসে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের চেহারার দিকে তাকান না, আর তোমাদের সম্পদ-ঐশ্বর্যের প্রতিও দৃষ্টি দেন না। তিনি দেখেন তোমাদের মন ও আন্তরিকতা।’

ঈদুল আজহার আনুষ্ঠানিকতায় মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় নির্দেশ ও ঐতিহ্য হিসেবে পালনীয় কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষাকে জীবনে প্রতিফলিত করতে পারলেই মিলবে আল্লাহর বান্দা হিসাবে সার্থকতা। পশু কোরবানির পাশাপাশি নিজের কু-রিপুকে সংশোধন করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় কোরবানি।

ঐতিহাসিকভাবে বিধিবদ্ধ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে বিশ্বের মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে শরিয়তসম্মতভাবে পশু জবাই করে কোরবানি করেন। যা আল্লাহর আদেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোরবানি দেওয়ার ঘটনা হতে আরম্ভ হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন আল্লাহতালার আদেশে প্রাণপ্রিয় ধৈর্যশীল পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর গলায় ছুরি চালালেন, তখন তা অলৌকিকভাবে এক পশুতে রূপান্তরিত হলো।

প্রকৃতপক্ষে তা ছিল হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য আত্মউৎসর্গের এক পরীক্ষা। একই সঙ্গে মানুষের জন্য কোরবানির শিক্ষা। পবিত্র কোরআনে সূরা সাফফাতে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এ যে সুস্পষ্ট পরীক্ষা ছিল। আমি তার বদলে এক বিরাট জবেহ করার জন্তু দান করলাম। তারপর যারা আসবে তাদের জন্য এ কথাটি কায়েম রাখলাম।’

এ আয়াতের মাধ্যমে জীবন উৎসর্গের মত দুরূহ কাজ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে পশু দিয়ে কোরবানি করা মুসলমানেদের জন্য ওয়াজিব হয়েছে। পশু জবাই করে ঈদ আনন্দে শুধু উল্লসিত হলে চলবে না। বরং কোরবানি শুধু মহান আল্লাহয়ালার নামে ও উদ্দেশ্যেই করতে হবে। এতে কোনো রকম সামাজিকতা, লোক দেখানো বিত্তশালী ভাব, প্রতিযোগিতা, পরশ্রীকাতরতা নিন্দনীয়। আর ত্যাগের মনোভাবের বদলে এ ধরনের বিষয় থাকলে কোরবানি আল্লাহতায়ালার কাছে কবুল হবে না।

ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী, হজরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানিই হলো মানব জাতির জন্য কোরবানির আরেক অনন্য উদাহরণ। হাবিল ও কাবিলের মধ্যে বিয়ে করা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তাদের পিতা হজরত আদম (আ.) উভয়কে আদেশ দেন ইখলাসের দ্বারা দুম্বা কোরবানি করতে। সেই সঙ্গে বলেন, যার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে আর আলামত হিসেবে আসমান থেকে আগুন এসে কোরবানি করা পশুকে জ্বালিয়ে দেবে, তারই বিয়ে হবে। এ কথা শুনে হাবিল ও কাবিল দু’জনে কোরবানি দিলো। আল্লাহ হাবিলের কোরবানি কবুল করলেন। এতে কাবিল ক্রুব্ধ হয়ে হাবিলকে হত্যা করল। হাবিল ও কাবিলের এ ঘটনা থেকে বোধগম্য হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে কোরবানি করাতে ইখলাস ও তাকওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর আল্লাহ কবুল করেন কেবল শুদ্দাচারী কিংবা পরহেজগারদের কোরবানি। হজরত আদম (আ.)-কে অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে অন্যান্য রাসূলগণও আল্লাহর নামে কেবল তারই সন্তুষ্টির জন্য কোরবানির পথ দেখিয়ে গেছেন মানবজাতিকে।

এ জন্য কোরবানি মানে কেবল পশু জবাই নয়। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে তার নৈকট্য লাভের জন্য পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইবাদত। তাই মানুষের কু-রিপু অর্থাৎ আমিত্ব, অহংকার, দাম্ভকিতা, পশুত্ব, ক্ষুদ্রতা নিচুতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, লোভ, লালসা ও পরশ্রীকাতরতা ত্যাগের মাঝেই নিহিত আছে কোরবানির মূল নির্যাস।

কোরবানি আমাদেরকে যাবতীয় পাপাচার থেকে মুক্ত করে পরিশুদ্ধির পথে উজ্জীবিত করবে এবং আল্লাহর জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভে ধন্য করবে এবং আমাদেরকে শয়তান ও নফস বা রিপুর প্ররোচনা থেকে মুক্ত হয়ে ইহ ও পরকালীন কল্যাণের পথে প্রণোদিত করবে, এটাই প্রত্যাশিত। 'তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম', আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের ইবাদত-বন্দেগি কবুল করুন। সবাইকে ঈদ মোবারক।