কারা হেফাজতে কয়েদির মৃত্যু: জেল সুপার ও ওসিসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধ মামলা
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এক হাজতবাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় সিনিয়র জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন ও বোয়ালখালী থানার ওসিসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করা হয়েছে। ওই কারাভোগকারীর নাম রুবেল দে।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার আবেদন করেন নিহত হাজতির রুবেলের স্ত্রী পুরবী পালিত।
মামলার বাকি আসামিরা হলেন— চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ এমরান হোসেন মিয়া, ডেপুটি জেলার নওশাদ মিয়া, মো. আখেরুল ইসলাম, সুমাইয়া খাতুন, ইব্রাহিম, বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আছহাব উদ্দিন, একই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাইফুল ইসলাম, উপপরিদর্শক আবু মুসা, মো. সাইফুল ইসলাম, রিযাউল জব্বার, ডিউটি অফিসার, কনস্টেবল কামাল, আসাদুল্লাহ এবং কারাগারের ওয়ার্ড মাস্টার।
মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে বোয়ালখালী উপজেলার দক্ষিণ জৈষ্ট্যপুরার নিজ বাড়ি থেকে থানার ওসির নির্দেশে উপপরিদর্শক এস এম আবু মুসা সঙ্গীয় অফিসারসহ চৌকিদার জয় চক্রবর্তী এবং ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য চৌধুরী মো. হাসান চৌধুরী যোগসাজশক্রমে ও সহযোগিতায় বিনা কারণে গ্রেপ্তার করে রুবেল দে (৩৮)'কে। এরপর অভিযান পরিচালনা করে তাকে রাত ৮টার দিকে মদসহ অবস্থান করার তথ্যে গ্রেপ্তার করার ভুয়া মামলা সাজায়। ওইদিন রাত ৯টার দিকে পুলিশ কল করে রুবেল দে'কে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তার পরিবারের কাছে ২ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে। টাকা না দিলে ৫শ লিটার চোলাই মদ দিয়ে মিথ্যা মাদক মামলা সাজিয়ে চালান দেয়া হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী রুবেলের পরিবার এত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা ২শ লিটার চোলাই মদ উদ্ধারের মিথ্যা এজাহার প্রস্তুত করে থানায় বসে ভুয়া জব্দ তালিকা তৈরি করেন এবং একজন আসামি নিজে বাদী হয়ে বোয়ালখালী থানায় রুবেলের নামে মিথ্যা মামলা রুজু করেন। পরদিন বোয়ালখালী থানার উপপরিদর্শক রিযাউল জব্বার রুবেল দে'র শারীরিক আঘাতের কথা গোপন রেখেই তাকে আদালতে সোপর্দ করেন। আদালত রুবেলকে হাজতে পাঠানোর আদেশ দিলে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় প্রিজন ভ্যানে করে তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর ২ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রুবেলের পরিবার সাক্ষাৎ করার জন্য কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলে দেখতে পান, কারারক্ষীরা মুমূর্ষু অবস্থায় রুবেলকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে এসেছেন। এসময় তারা দেখতে পান, রুবেলের কপালে, ডান চোখের ভ্রু-র ওপর রক্তাক্ত কাটা জখম। মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরছে। সারা মুখমণ্ডল ফোলা জখম হয়ে আছে এবং প্রচণ্ড আহত ও নিস্তেজ অবস্থায় মাথা হেলিয়ে পড়ে আছে। এমনকী কথা বলার কোনো শক্তি বা অবস্থা তার মধ্যে ছিল না। এমন অবস্থার কারণ জানতে চাইলে কারারক্ষীরা কোনো জবাব দেননি।
এ ঘটনার কথা রুবেল দে'র আইনজীবীকে জানানো হলে মামলার ১ থেকে ৯ নম্বর আসামিদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ১০ থেকে ১৫ নম্বর আসামিরা ভুক্তভোগীকে তাদের হেফাজতে অকথ্য নির্যাতন করেন, যার প্রেক্ষিতে ৪ জানুয়ারি রুয়বেলের আইনজীবী তার বিরূপ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণে জেল সুপারকে আদেশ প্রদানের জন্য জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৬নং আদালতে একটি দরখাস্ত দেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আদালতকে অবহিত করতে জেল সুপারকে নির্দেশ প্রদান করেন। পরদিন সকাল ৮টায় রুবেল দে'র স্ত্রী পুরবী পালিত ইউপি সদস্য প্রদীপ সূত্রধরের মাধ্যমে জানতে পারেন তার স্বামী মারা গেছেন এবং লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। এরপর রুবেলের পরিবার মর্গে গিয়ে সেখানে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়।
মামলার আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাদীপক্ষের আইনজীবী অজয় ধর বলেন, 'গত ৪ জানুয়ারি ষষ্ঠ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জেল সুপারকে আমার মক্কেল রুবেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন, আর রাতেই তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। জেল সুপার এই দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, আমার মক্কেল পুলিশ হেফাজতে পুরোপুরি সুস্থ ছিল।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, বোয়ালখালী থানার ওসিসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেছেন রুবেলের স্ত্রী পুরিবী পালিত।'
তিনি আরো বলেন, 'মামলায় নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩-এর ১৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত মামলার আবেদন জমা নিয়ে যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী শুনানির জন্য তারিখ দেবেন বলেছেন।'