করোনা মোকাবিলায় কৌশলগত পরিবর্তন দরকার

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা। তাদের মতে, এখনই পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।

শনিবার (২৯ আগস্ট) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে তারা এ মত জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

ওয়েবিনারে অংশ নেন ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স এর মেডিক্যাল এনথ্রোপোলজি অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথ বিভাগের রিডার ডা. শাহাদুজ্জামান, জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ এবং পাবলিক হেলথ, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক তৌফিক জোয়ার্দার ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

সঞ্চালনা করেন বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক ওয়েবিনার আয়োজন করছে।

বিজ্ঞাপন

ডা. শাহাদুজ্জামান বলেন, সাধারণ চিকিৎসা আর মহামারি মোকাবিলায় কিছু ভিন্নতা আছে। মহামারি বিষয়টি পুরোপুরি পাবলিক হেলথ ইস্যু। আর করোনা মোকাবিলায় প্রথমে দরকার সংক্রমণ বন্ধ করা। ঘরে থেকে আর হাত ধুয়ে মানব জাতির এত উপকার করা যায় সেটা জানার সুযোগ সভ্যতার এত বছরে আসেনি। আমাদের জনগণের চিন্তাধারা কিওরেটিভ ওরিয়েন্টেড। তারা ডাক্তারের মুখ থেকে শুনতে চান। একজন চিকিৎসক যিনি সারা জীবন হাসপাতালে কিংবা চেম্বারে বসে রোগী দেখেছেন, তার পক্ষে হাসপাতালের সম্পূর্ণ বাইরের একটি বিষয় জানার কথা না। যদিও করোনা মোকাবিলায় তারাই প্রধান ভূমিকা রেখেছেন।

তিনি বলেন, শুরু থেকে আমাদের ফ্রেমিংটা ভুল ছিল। করোনাকে মেডিক্যাল সমস্যা হিসেবে হিসেবে দেখা হয়েছিল, কিন্তু করোনা একটি পাবলিক হেলথ প্রবলেম আর পাবলিক হেলথের একটি বড় অংশ হলো কমিউনিকেশন। আর মহামারিতে দরকার সামাজিক যৌথ উদ্যোগ, সেখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করার প্রধান বিষয় হলো কমিউনিকেশন। করোনা মূলত কমিউনিকেশন প্রবলেম। তার কিছু বিষয় আমরা দেখেছি। যাকে আমরা বলি, ফিয়ার অব আননোন। মহামারি এমনিতেই আতঙ্ক তৈরি করে। সেখানে কোভিড-১৯ এর ভিন্নতা অনেক বেশি। শুরুতে কিছু অপপ্রচারের কারণে আমরা বেপরোয়া চলাফেরা করেছি। করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে প্রবাসীদের নিগ্রহ শুরু হলো। প্রথমে তাদের কোয়ারেন্টিন সিল মেরে দেওয়া হয়— এটা একটা ভিন্ন লোক। এরপর গ্রামে তাদের বাড়িতে বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হয়— এটা প্রবাসীর বাড়ি। এটা ফরমাল স্টিগমাটাইজেশন। সংক্রমণের সূত্রপাত প্রবাসীদের মাধ্যমে হলেও পরবর্তীতে স্পয়েল্ড আইডেন্টিটি দেখা গেল। তখন যেটা হলো— প্রবাসী মানেই আতঙ্কের উৎস। এরপর ইনফরমাল স্টিগমাটাইজেশন দেখা গেল। প্রশাসন থেকে যখন বলা হলো এরা ভয়ের উৎস, চায়ের দোকান থেকে শুরু বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার দেখা গেল প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ। প্রবাসীদের পেটানোও হয়েছে।

প্রথম যখন একজন মারা গেলেন, তিনি প্রবাসী ছিলেন না। তখন প্রকৃত অর্থে এক ধরনের ভীতি তৈরি হলো। এরপর লকডাউনে এসে আরেকবার ভীতি তৈরি হলো। পোশাক শ্রমিকদের ছুটি দেওয়ার পরে আবার ফিরিয়ে আনা হলো। তখন ফিয়ার অব লাইফের সঙ্গে ফিয়ার অব লাইভলিহুড যোগ হলো। চিকিৎসকদের পিপিই ছিল না, তারা রোগী দেখতে ভয় পাচ্ছিলেন। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম, বড় একটি অংশের মানুষের কোনো ভয় নেই। তখন লকডাউনের মাঝামাঝি পর্যায়। এই ভয়হীনতা আরও কিছু মানুষের ভীতির কারণ হয়েছে। ফিয়ার তখন প্যানিক পর্যায়ে গেল। রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, করোনা রোগীর বাড়িতে হামলা হয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ বাস্তব পরিস্থিতি জানতে চায়। প্রশাসনের দায়িত্ব হলো মানুষকে বাস্তব পরিস্থিতি জানানো। এখনো স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করা দরকার। করোনা মোকাবিলা পাবলিক হেলথ ওরিয়েন্টেটেড করা দরকার। তাছাড়া সেকেন্ড ওয়েভ এলে সামলানোর কোনো উপায় থাকবে না— বলেন ডা. শাহাদুজ্জামান।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডেঙ্গুর সময় আমরা দেখেছি, যারা সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন তাদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল না। একই পরিস্থিতি আমরা আবার দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে রাজনীতিবিদরা উপেক্ষা করছেন, যে কারণে সাধারণ মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি ঈদুল আযহায় বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। আস্থাহীনতা তৈরিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের দায় আছে। কেউ কেউ ওষুধ পেয়ে গেছি বলেছেন, সেটা কিন্তু পরবর্তীতে জনগণকে আস্থাহীনতায় ফেলেছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল প্রান্তিক মানুষ নয় শিক্ষিত মানুষের ভেতরেও হেলথ লিটারেসির অভাব আছে।

ডা. তৌফিক জোয়ার্দার বলেন, মহামারি ছাড়াও বাংলাদেশের হাসপাতালে রোগী নেই এটা ভাবা যায় না। কেউ যদি দাবি করেন হাসপাতালগুলোতে রোগী নেই, এর অর্থ হলো মানুষ হাসপাতালে যেতে সাহস পাচ্ছে না কিংবা তারা মনে করছে না, হাসপাতালে গিয়ে তারা সঠিক চিকিৎসা পাবে। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি। আমরা একটি গবেষণা করেছি, তাতে দেখা গেছে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা, চিকিৎসক ও চিকিৎসা দানকারীদের ওপর জনগণের এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চিকিৎসক ও চিকিৎসা দানকারীদের আস্থা কম। হঠাৎ আমরা দেখলাম কিছু মানুষকে পরিবর্তন করে দেওয়া হলো। অথচ যতক্ষণ সিস্টেমে পরিবর্তন না আনা হচ্ছে, ব্যক্তির পরিবর্তন বড় ভূমিকা পালন করবে না।