হয়ে গেলো পদ্মা সেতু!
গত কয়েকদিনের তুলনায় আজকে কুয়াশাও কমে গেছে! মাঝনদীতে দাঁড়ানো পদ্মা সেতুর অবয়ব দূর থেকে আরো স্পষ্ট! দেখে মনে হলো আবহাওয়াও যেন বাংলাদেশের বিজয় গাঁধা লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। তাই তো নির্দিষ্ট সময়েই নির্বিঘ্নে স্বপ্নের সেতুতে বসানো হলো শেষ স্প্যান। সেই সঙ্গে দুইপার জুড়ে দিয়ে বিশাল পদ্মার বুকে সেতু দৃশ্যমান হলো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারে।
বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) বেলা ১২টা ২ মিনিটে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ৪১ নম্বর স্প্যানটি। বিষয়টি বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছেন পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের।
এর আগে বুধবার (৯ ডিসেম্বর) ৩ হাজার মেট্রিক টন ওজনের সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি ভাসমান ক্রেনে করে মাওয়ার কুমারভোগ এলাকার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির কাছে নিয়ে আসা হয়। যাতে প্রতিকূল আবহাওয়া থাকলেও স্প্যানটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যেন বসানো যায়। স্প্যান বসানো কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৯টা থেকেই।
পদ্মা পাড়ের সাধারণ মানুষ জানান, ভৌগোলিকভাবে আমরা এই অঞ্চলের মানুষরা একটু অবহেলিতই ছিলাম। তবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু থেকেই আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। নতুন করে সম্ভাবনার দুয়ার আমাদের জন্য খুলবে এই আশায়। এই সেতু ঘুচাবে ভৌগোলিক বিভেদ। প্রয়োজনে, বিপদে, আপদে এই নদী পাড়ি দেওয়া ছিলো আমাদের জন্য অনেক কষ্টের ভোগান্তির। এসবের অবসান হতে চলেছে অচিরেই। আমরা পাড়ি দেবো দেশের সবচেয়ে বড় সেতু। আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
বাংলাদেশের জন্য ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ সালটি ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। ওইদিন বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই সেতুর বুনন কাজের উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এরপর আরেকটি ইতিহাস রচনা হয় ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে। সেদিন পদ্মা বুকে সেতুর প্রথম স্প্যান বা ইস্পাতের কাঠামোটি বসানো হয়। এরপর পার হলো তিন বছর দুই মাস, একে একে বসে বসে গেলো ৪১টি স্প্যান। মিলন ঘটল মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত আর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের। সেতুর গুরুত্বপূর্ণ এই কাজ শেষের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ২৯ জেলার সঙ্গে ঢাকার সহজ যোগাযোগের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে।
দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুতে এসব স্প্যান বসছে ৪২টি পিয়ার বা খুঁটির ওপর। স্প্যানের ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন।
পুরো সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ৪২ টি। একটি থেকে আরেকটি পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। স্প্যানের অংশগুলো চীন থেকে তৈরি করে বাংলাদেশে আনা হয়।
তাছাড়া, ৬.১৫ কিলোমিটার দ্বিতল এই সেতুর সড়কের জন্য লাগবে দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব। এ ছাড়া রেললাইনের জন্য লাগবে দুই হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব।বর্তমানে পদ্মা সেতুতে এসব স্ল্যাব বসানোর কাজ চলমান আছে। এরিমধ্যে বেশির ভাগ বসে গেছে রোডওয়ে ও রেলওয়ে স্ল্যাব। এখন যেহেতু সব স্প্যান বসানোর কাজ শেষ তাই সামনের দিকে স্ল্যাব বসানোরে কাজে আরো গতি আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগিত ৯১ শতাংশ, নদীশাসনকাজের ৭৫.৫০ শতাংশ, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকার কাজের শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২.৫০ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
২০০৭ সালে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। এই প্রকল্পের অর্থ ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও আবুধাবি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ -এই পাঁচটি সংস্থা। সংস্থা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের দেওয়ার কথা ছিল ১২০ কোটি ডলার। আর জাইকার দেওয়ার কথা ছিল ৪১.৫ কোটি ডলার। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ জুন অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়।
বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহারের পর ২০১২ সালের ১০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন।
কয়েকবার পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ও ব্যয়ের ঘোষণা দেওয়া হলেও নির্ধারিত সময় ও ব্যয়ে কাজ সম্পন্ন হয়নি। ২০১১ সালে নির্ধারণ করা ব্যয় সংশোধন করে পরবর্তী সময়ে ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এসে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৩০ হাজার ১৯৩.৩৯ কোটি টাকা। গত ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পে মোট খরচ হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫.০২ কোটি টাকা। সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হতে আরও এক বছর সময় লাবে। এতে ব্যয় আরো বাড়তে পারে জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু: বিজয়ের মাসে আরেক বিজয়