‘বিদ্যুৎকে প্রাইভেট পণ্য মনে করার সময় এখনও আসেনি’
বিদ্যুৎকে প্রাইভেট পণ্য মনে করার সময় এখনও আসেনি। জ্বালানির দাম বাড়লেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো প্রধানমন্ত্রী সমর্থন করেন না। যে কারণে অল্প অল্প করে দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী।
শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি) আয়োজিত ‘বিজয়ের ৫০ বছর ও বিদ্যুৎ খাতের অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, বিদ্যুতের সিস্টেম লস অনেক বেশি থাকায় ১৯৯৬ সালে দাতারা বলে দিল তোমাদের টাকা দেওয়া হবে না। তখন আমরা আইপিপিতে গেলাম। খুলনা, হরিপুরে বার্জে করে পাওয়ার প্লান্ট এনে স্থাপন করা হলো। এরপর ক্যাপটিভ পাওয়ার পলিসি করা হলো। যদি ক্যাপটিভ তার উদ্বৃত্ত বিক্রি করতে চায় তার ব্যবস্থা করা হলো। এভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি পরিবর্তন করা হয়। তখন কিন্তু সরকারের মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। প্রধানমন্ত্রী তখন সাহসী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
২০০৯ সালে দেখলাম বিশ্বব্যাংকের ফরমুলায় করা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনে দ্রুত কাজ করা সম্ভব না। ফিলিপাইন তখন একটি নির্বাহী আদেশে কাজ করছিল। তখন আমরা বিশেষ আইন করলাম, অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি অনেক, বিরোধীদল কিংবা মিডিয়াকে খুশি করা না, সাধারণ মানুষকে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়। আমেরিকায় অর্জন হলে প্রেসিডেন্টের কথা আসে। বাংলাদেশে প্রথম আসে নেতৃত্বের কথা। ভবিষ্যতে এনার্জি এফিশিয়েন্সির দিকে যেতে হবে। কিভাবে ভবন এনার্জি সাশ্রয়ী করা যায় সেদিকে যেতে হবে।
লিকুইড ফুয়েল থেকে কিছুটা বের হয়ে আসবো। ইন্ট্রিগেটেড সিস্টেমের দিকে যাচ্ছি, এখানে কিছুটা ঝুঁকিও রয়েছে। যেমন রাশিয়া বসে ইউক্রেনের পাওয়ার সিস্টেম ড্যামেজ করে দিয়েছে। আমরা যদি অনুকরণ করি তাহলে পিছিয়ে থাকবো, আর যদি নিজেরা উদ্ভাবনী মেধা প্রয়োগ করি তাহলে এগিয়ে থাকবো।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জামায়াত-বিএনপি বাংলাদেশকে ৫০ বছর পেছনে ঠেলে দিয়েছে। কিভাবে দেশের উন্নয়ন করবে তার কোনো প্লান ছিল না। তাদের সময়ে বিদ্যুৎ এনার্জির জন্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ সরকার মোকাবিলা করেছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ফের ক্ষমতায় এসে বিগত সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ও পরিকল্পনাসহ বন্ধ করে দেয়।
২০০৯ সালে সারা দেশে আলোকিত করার কথা বলা হলো ইশতেহারে। তখন টাকশালে টাকা নেই, তেল কেনার পয়সা নেই। ওই সময় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। একটি আইন এই জায়গাটিকে পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সাহস করে যে পরিবর্তন করা যায়, তখন সেই সাহসটি দেখিয়েছেন। অনেকে সমালোচনা করেন বিশেষ আইন নিয়ে। এই বিশেষ আইন করার সুফল আজকে পাচ্ছি।
অনেকে লিকুইড ফুয়েল, রেন্টাল নিয়ে কথা বলেন। তাদের ধারণাই নেই, এগুলো না হলে আজকের ভালো অবস্থায় আসা সম্ভব হতো না। পৃথিবীতে এই ধরনের কেসস্ট্যাডি খুবই বিরল। আমার কাছে মাঝে মাঝে আশ্চর্যজনক মনে হয়। ২০১৪ সালে যখন আমাকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়, তখন অনেকে তদবির করতেন বিদ্যুতের জন্য, সত্যি বলতে কি আমি কিছুটা হলেও নার্ভাস ছিলাম। একদিন প্রধানমন্ত্রী ডেকে পরামর্শ দিলেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ১৯৭৭ সালে হয়েছে বলে অনেকে মিস কোর্ড করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে প্রকৌশলীদের সমাবেশে এই সংস্থার বিষয়ে বক্তব্য দেন। তার ধারাবাহিকতায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড স্থাপিত হয়।
তিনি বলেন, আমরা শুধু বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াইনি, আমরা এখন সিস্টেম লস সিঙ্গেল ডিজিটে এনেছি। বিদ্যুৎ খাতে একটি দক্ষ টিম কাজ করছে। যার ফলে আজকে ৩ কোটি ৮৯ লাখ গ্রাহকে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ১ কোটি ৮ লাখ সংযোগ। ২০০৯ সালে ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৪৯৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল, এখন ১৪০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট। প্রধানমন্ত্রী সর্বত্র একই মূল্যে বিদ্যুৎ বিতরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বিপপার সভাপতি ইমরান করিম বলেন, ১০/১২ বছর আগে যেমন বিদ্যুৎ খাত দেখেছি। আজকের সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না। ২০০৯ সালে এটি চিন্তাও করা যায়নি। প্রাইভেট সেক্টরকে এই খাতে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল যুগপোযোগী। আরেকটি ভালো বিষয় ছিল ফুয়েল মিক্স। ওই সময়ে অনেক এজেন্সি এটিকে ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু তাদের শঙ্কা অসার প্রমাণিত হয়েছে।
সিআরআই পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ২০০১ সাল পর্যন্ত আইপিপিতে বাংলাদেশ মডেল হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। বিদ্যুৎ খাতের ধারাবাহিকতা ছিল না, ছন্দপতন হয়েছে। আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে। সঞ্চালন ও বিতরণে বড় বিনিয়োগ করতে না পারলে মানসম্মত বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা কঠিন। বিদ্যুতের দাম দ্রুত বেড়েছে। এইভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়লে ভালো হবে না।
এফইআরবি চেয়ারম্যান অরুণ কর্মকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইডি শামীম জাহাঙ্গীর।