মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ফের বাংলাদেশ সফর করছেন। উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে সরব থাকা এই কূটনীতিকের ঢাকা সফর উল্লেখের দাবি রাখে। যদিও তার এই সফর রাজনৈতিক কর্মসূচিভিত্তিক নয়, স্রেফ কূটনীতিক সফর।
নানা কারণে এ-অঞ্চলে আলোচিত ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশের সবশেষ অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে সরব ছিলেন তিনি। আলোচিত ছিলেন ভিসানীতি নিয়ে চলা সকল আলোচনায়। বাংলাদেশের নির্বাচনের রাজনীতি নিয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো পরিস্থিতির তৈরি করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া নিয়ে হম্বিতম্বি ছিল মার্কিনীদের। বাংলাদেশ সফর করেছেন একাধিকবার। তাদের সেই সব সফর, নানা মন্তব্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে। সরকার বিব্রত হয়েছে, সরকারবিরোধী দল বিএনপি আশাবাদী হয়েছে, জনগণ ছিল অনিশ্চয়তায়।
গত জানুয়ারিতে বিএনপি ও সমমনা দল আর জোটগুলোর বর্জনের মধ্যে দিয়ে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুমিতভাবে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা থেকেছে। নতুন সরকারের সঙ্গে আমেরিকার আগের সম্পর্ক এখন নেই। বাংলাদেশ-আমেরিকার মধ্যকার অবিশ্বাসের যে সম্পর্ক সে সম্পর্ক যদিও মধুর হয়নি, তবে বিধুর সম্পর্কের পর্যায় থেকে কিছুটা সহনশীলতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আগের মতো আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী-এমপিরা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও আমেরিকার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করছেন না।
দ্বাদশ সংসদ নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক আলোচনা ছিল। আলোচনায় ছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তার অতি-তৎপরতা সে সময় আলোচিত ছিল, সমালোচিত ছিল। তবে নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে ছিলেন এই মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এরপর মন্ত্রণালয়-মন্ত্রণালয়ে গিয়ে অবিশ্বাস দূর করার চেষ্টা করেছেন, সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে জোর দিয়েছেন। নির্বাচনের আগের আমেরিকা আর নির্বাচনের পরের আমেরিকার অবস্থানের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তখন। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আশা ছিল নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না আমেরিকা, এমনকি সহযোগিতা বন্ধ করে দেবে, ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে; কিন্তু এর কিছুই হয়নি। আমেরিকা নতুন সরকারকে ‘অভিনন্দন বার্তা’ না পাঠালেও সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘আমেরিকা-বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি দুই দেশের জনগণের শক্তিশালী সম্পর্ক’ উল্লেখ করে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থনের পাশাপাশি একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। চিঠিতে জো বাইডেন লেখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র–বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করার ঐকান্তিক ইচ্ছা আমি তুলে ধরছি।’
বাইডেনের ওই চিঠির জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে বলে দৃশ্যমান হয়। যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ছিল আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রে, সেটা আগের মতো থাকেনি। ভিসা নিষেধাজ্ঞা, শ্রমনীতি নিয়ে নিষেধাজ্ঞার যে আলোচনা সেটাও কমতে শুরু করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আলোচনার বাইরে চলে যাওয়ায় এ-নিয়ে এখন দেশেও কেউ কথা বলছে না। সরকারের মধ্যকার থাকা বিব্রতকর অবস্থা কমতে শুরু করেছে, নির্বাচনের আগে আমেরিকাকে নিয়ে বিপুল আশাবাদী হয়ে ওঠা বিএনপিও বুঝতে পারছে মার্কিনীদের ওপর নির্ভর করে থাকাটা সঠিক ছিল না তাদের।
নির্বাচনের আগে পিটার হাস ও তার ভূমিকা নিয়ে এতখানি মগ্ন ছিল বিএনপি যে, ওই রাষ্ট্রদূত ‘অবতার’ হয়ে এসেছেন বলে প্রকাশ্য বৈঠকে মন্তব্য করে। পিটার হাসকে অবতার আখ্যা দেওয়া ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর তখন ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং খালেদা জিয়া সরকারের দুইবারের প্রতিমন্ত্রী। আন্দোলন চলাকালে নাশকতার একটা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন। এরপর জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে তিনি বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন, এবং বিজয়ীও হন। কেবল শাহজাহান ওমরই নন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বারবার ধর্না দিয়েছেন পিটার হাসের কাছে, গোপন বৈঠকও করেছেন একাধিকবার। এর কিছু তারা স্বীকার করেছেন, আবার কিছু বৈঠকের তথ্য প্রথমে স্বীকার করলেও পরে অস্বীকার করেছেন।
সরকার হটাতে একদা আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বিএনপি। এই অতি-নির্ভরশীলতার একটা পর্যায়ে তারা জনগণের ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করেছিল প্রায়। নির্বাচনের পর বাংলাদেশ-আমেরিকার সম্পর্কে স্বাভাবিকের পথে যাওয়ায় প্রথমে তারা ভারতকে দুষেছিল। আর এখন ঠিক রাজনীতির পথে ফিরতে শুরু করেছে। আমেরিকা নিয়ে তাদের আশাবাদে ধাক্কা লাগায় এখন তারা ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফর নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেই তার প্রমাণ মিলেছে। তিনি বলেছেন, ‘কে আসলো আর কে গেলো তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।’ মির্জা ফখরুল বলছেন, ‘তাদের দলের প্রধান শক্তি হলো জনগণ।’ কেবল মির্জা ফখরুলই নন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর আসা-না আসায় কিছু যায়-আসে না। লু তো অনেক দূরের কথা। আমরা শঙ্কিত দেশের অবস্থা নিয়ে।’ তিনি ডোনাল্ড লুর সফরের চাইতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘কুকি- চিনের’ আচরণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। তার দাবি, ‘সরকার এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।’
ডোনাল্ড লু কলম্বো হয়ে ঢাকা এসেছেন। তার সফরসূচি এই অঞ্চল নিয়ে তাদের আগ্রহের কথাটাই বলছে। সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, পররাষ্ট্র সচিব ড. মাসুদ বিন মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে তার। সফরসূচিতে বিএনপির সঙ্গে সাক্ষাতের সূচি এখন পর্যন্ত নেই। অর্থাৎ সফরটা আগাগোড়া কূটনৈতিক, সরকারের ভাষ্যে সম্পর্কোন্নয়নের।
জো বাইডেনের চিঠিতে উল্লেখ ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্ব’ শব্দগুলো ডোনাল্ড লুর বর্তমান সফরে আলোচিত হচ্ছে। সরকার এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, বিশেষ করে নানা বক্তব্যে-মন্তব্যে। সফরসূচিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি না থাকায় ডোনাল্ড লু যে বাংলাদেশে আসছেন অংশীদারত্বমূলক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে তা দৃশ্যমান হচ্ছে।
ডোনাল্ড লু এবারের সফর আর ঠিক আগের ঢাকা সফরের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দৃশ্যমান। আগে যখন তিনি এসেছিলেন তখন বিএনপি ছিল আশাবাদী হওয়ার দলে, সরকার ছিল বিব্রতকর অবস্থায়। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আগের আশাবাদীরা এখন হতাশ, আবার আগের বিব্রতকর অবস্থায় থাকারা এখন আশাবাদী হওয়ার দলে। দেশে-দেশের সম্পর্ক, কূটনীতি ও কূটনীতিক, এমনই তো হয়! নয় কি?