দিনাজপুরে অস্তিত্ব সংকটে ২১টি নদী
দিনাজপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ২১টি নদী। বয়ে যাওয়া খরস্রোতা এই নদীগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে এখন মৃতপ্রায়। নদী থেকে হারিয়ে গেছে জীব-বৈচিত্র। নদীর বুকে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। গড়ে উঠেছে, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, হাট-বাজার, ক্লাব-সমিতিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। এতে দিনাজপুরবাসী যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ।
প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে খরস্রোতা নদীগুলোর অস্তিত্ব বিলীণ হচ্ছে। পেশা বদল করছে নির্ভর জনগোষ্ঠি। নদী দূষণ দখলদারিত্ব এবং অন্যান্য দূষণ থেকে নদী রক্ষা ও নদী সংরক্ষণ শীর্ষক উদ্ধুদ্ধকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মশালা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতায় তা কাগজ-কলমেই থেকে যাচ্ছে। তবে, জেলার সব নদীর হালনাগাদ তথ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য নদীগুলো পূণঃখনন করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
দিনাজপুরের নদীগুলো এখন ধু-ধু বালু চর আর ফসলের ক্ষেত। রবি শষ্য থেকে শুরু করে ইরি, বোরো, পাট, গম, ভুট্টা, বেগুন, মরিচসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ হচ্ছে এখন নদীর বুকে। হঠাৎ দেখে কেউ বুঝতে পারবেনা এটি নদী। কথিত আছে এই নদীগুলোতে সারা বছর স্রোত থাকায় নৌকায় করে জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। অনেক নদী দিয়ে পালতোলা নৌকা ও জাহাজ চলতো। কালের আবর্তে নদীগুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে এখন মরে গেছে। ফলে এই জেলার অনেক জেলে বেকার হয়ে বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছে।
পূণর্ভবা, আত্রাই, ধলেস্বর, গর্ভেশ্বর, ইছামতি, ছোট যমুনা, তুলাই, কাঁকরা, ঢেপাসহ দিনাজপুরের মানচিত্রে প্রবাহমান ২১টি নদী।এক সময় এসব নদীর পানি সেচ দিয়েই খরা মৌসুমে নদীর আশপাশে হতো ফসলের চাষাবাদ। এখন সেচ নয়, নদীর বুকেই হয়েছে ফসলের ক্ষেত। খনন ও সংস্কার না হওয়ায় নদীগুলো তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা ভরাট নদী দখল করে আবাদি জমির ন্যায় সীমানা আইল দিয়ে পৈত্রিক সম্পত্তির মতো চাষাবাদ করছে। কেউ বা গড়ে তুলেছে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, হাট-বাজার, ক্লাব-সমিতিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এছাড়াও বর্জ্য দূষণের পাশাপাশি নদীগুলো থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন হচ্ছে। এতে নদীগুলোর পাড় ভেঙে যাচ্ছে। ফলে গতিপথও পরিবর্তন হচ্ছে নদীর। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ।
উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার, জলবায়ু পরিবর্তন, নাব্যতা কমে যাওয়া, অপরিকল্পিত বালু উত্তল, দখল ও দূষণে অস্তিত্ব বিলীণ হচ্ছে নদীগুলো। পানির অভাবে সংকটে নদী অববাহিকার এক সময়ের সমৃদ্ধ জনপদ। এ অঞ্চলের পরিবেশ-প্রকৃতি ও কৃষি-অর্থনীতি ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকট তীব্রতর হচ্ছে। এমনি অভিযোগ, নদীবর্তী এলাকাবাসী’র।
কৃষক মতিউর রহমান জানান, নদী’র পানি দিয়ে নয়, এখন শ্যালো মেশিনে সেচের পানি দিয়ে আবাদ হচ্ছে নদীতে। রবি শষ্য থেকে শুরু করে ইরি, বোরো, পাট, গম, ভুট্টা, বেগুন, মরিচসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ হচ্ছে এখন নদীর বুকে।
দিনাজপুরের বিশিষ্টজন পরিবেশবাদী আবুল কালাম আজাদ জানান, দিনাজপুরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। এতে দিনাজপুরবাসী যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে,তেমনি ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। বাঁধ মেরামতের নামে কাগজে-কলমে এই খরচ দেখানো হলেও বাস্তব চিত্র উল্টো। অভিযোগ রয়েছে- প্রতি বছরই বাঁধ মেরামত করার নামে দায়সারা কাজ করছে সরকারের এই সংস্থাটি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, পুরোপুরি বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা ও অনিয়মের কারণে বর্ষায় নদীর পানির চাপ বাড়লেই এসব বাঁধের হদিস মিলবে না। এমন অভিযোগ এলাকাবাসী’র।
শুধু তাই নয়, জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় খরা মৌসুমে খাবার পানি বা জমিতে সেচ দেয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ ফুট মাটির নীচে পাম্প স্থাপন করে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
নদী দূষণ দখলদারিত্ব এবং অন্যান্য দূষণ থেকে নদী রক্ষা ও নদী সংরক্ষণ শীর্ষক উদ্ধুদ্ধকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মশালা হয়েছে। নদীগুলো চিহ্নিত করে দখলমুক্ত করার কথা জানালেন,সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মর্তুজা আল মুঈদ।
জাতীয় নদী কমিশনের প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব ইকরামুল হক জানান, স্বাধীনতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নদীগুলো দখলমুক্ত করা প্রয়োজন।এজন্যে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টা ও জনসচেতনতা।
হারিয়ে যাওয়া নদীগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কারো কোন আগ্রহ বা উৎসাহ না থাকলেও নদী দখলকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত ঘটছে অনেক দুর্ঘটনা। বর্ষাকালে নদীতে স্রোত থাকলেও খরা মৌসুমে তা ফসলের বিস্তর্ মাঠ।
অবৈধ দথল, বর্জ্য দূষণ এবং অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে দিনাজপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব নদী। এতে পরিবেশ যেমন ভারসাম্য হারাচ্ছে, তেমনি বিনষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র। এসব নদী রক্ষায় সরকারের দৃষ্টি দেয়ার পাশাপাশি জনসচেতনতারও তাগিদ দিচ্ছেন পরিবেশবিদ এবং নদী বিশেষজ্ঞরা।