জামিন জালিয়াতিতে আদালত পাড়ায় একাধিক চক্র

  • ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালত থেকে এনআই অ্যাক্টের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন করতে ভুয়া ট্রেজারি চালান তৈরি করছে একাধিক জালিয়াত চক্র। এসব সংঘবদ্ধ চক্র জামিন জালিয়াতি থেকে শুরু করে আদালত প্রাঙ্গণে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। বিচারিক কার্যক্রমের ভুয়া কাগজপত্র তৈরিসহ আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীদের সাথেও প্রতারণা করছেন। দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধ জামিন জালিয়াত চক্রটি আদালত পাড়ায় সক্রিয়।

২০১৮ সালের দিকে ৭৮ লাখ ২৮ হাজার ৯৯১ টাকার একটি ব্যাংকের ট্রেজারি চালান জাল করে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে জামিন করায় চক্রটি। পরে প্রতারণা ধরা পড়লে এ বিষয়ে আদালতে একটি মামলা করেন জেলা জজ আদালতের আইনজীবী মো. রাসেল আহম্মেদ রনি। আদালতের নির্দেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানা মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে। সেই মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিতে বদলি হয়। জালিয়াত চক্রের মূলহোতাসহ আরও দুজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি।

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, এনআই অ্যাক্টের একটি মামলায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা অর্থদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামিকে জামিন করতে আদালতের বিচারক, আইনজীবী ও ব্যাংক কর্মকর্তার জাল স্বাক্ষর ও সীল ব্যবহার করে একটি জালিয়ত চক্র। ব্যাংকে জমা দেয়া ট্রেজারি চালানে বিচারক, আইনজীবী ও ব্যাংকের ভুয়া সীল স্বাক্ষর ব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর ওই আইনজীবী নিজে বাদী হয়ে চক্রটির বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করছে। গ্রেফতারের পর মামলার প্রধান আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ট্রেজারি চালান জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন।

এছাড়া জবানবন্দিতে জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনের নাম জানান তিনি। এরই সূত্র ধরে জালিয়াত চক্রের মুলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।

বিজ্ঞাপন

তথ্যমতে, এ চক্রটি ১৭টি ভুয়া ট্রেজারি চালান তৈরি করে আদালতের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্তদের জামিন করিয়েছে। এরকম আরও চক্র রয়েছে আদালত পাড়ায়।

সিআইডি বলছে, এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে জাল স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে ব্যাংকের ট্রেজারি চালান ভুয়াভাবে তৈরি করে আদালত থেকে আসামিদের জামিনে মুক্ত করার কাজে লিপ্ত ছিল। ৭৮ লাখ ২৮ হাজার ৯৯১ টাকার একটি ব্যাংকের ট্রেজারি চালান জালিয়াতি নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতের এক আইনজীর দায়ের করা মামলার তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আসামিরা জালিয়াত চক্রের প্ররোচনায় আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আবেদন করে থাকেন। এতে তারা বিচারক, আইনজীবী ও ব্যাংক কর্মকর্তার সাক্ষর ও শীল নকল করে ভুয়া ট্রেজারি চালান তৈরি করে। তাৎক্ষণিক ট্রেজারি চালানের সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় জালিয়াতচক্র এভাবে প্রতারণা করে। জালিয়াত চক্রকে খুঁজে বের করে যদি দ্রুত আইনের আওতায় আনা যায় তাহলে এসব কাজ পরবর্তীতে আর কেউ করবে না।

মামলার বাদী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী মো. রাসেল আহম্মেদ রনি জানান, মো. জুয়েল হক নামে এক আসামিকে এনআই অ্যাক্টের একটি মামলায় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও চেকের সমপরিমাণ ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের আদেশ দেন। এ আসামিকে জামিনের জন্য মাহিদুর নামে এক ব্যক্তি তার কাছে আসেন এবং রায়ের অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে আপিলের শর্তে জামিন করাতে চান। জামিনের শর্ত মোতাবেক ৭৮ লাখ ২৮ হাজার ৯৯১ টাকা জমা দেয়ার কথা বললেও ট্রেজারি চালানের প্রথম অংশ পূরণ করে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী ও অতিরিক্ত জেলা জজের স্বাক্ষর করে আদালতের হিসাব শাখা থেকে এন্ট্রি করা হয়।

এরপর ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার জন্য প্রধান আসামি মাহিদুরকে ট্রেজারি চালান ফরম দেয়া হয়। তবে মাহিদুর ও তার সহযোগীরা আইনজীবী কর্তৃক পূরণীয় অংশে আমার স্বাক্ষর, আদালত কর্তৃক পূরণীয় অংশে বিচারকের স্বাক্ষর ও ব্যাংক কর্তৃক পূরণীয় অংশে সোনালী ব্যাংকের সীল ও ক্যাশিয়ারের স্বাক্ষর জাল করে। জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত ট্রেজারি চালান আদালতে জমা দেন। শর্ত মোতাবেক আবেদনের প্রেক্ষিতে জামিন দেয় আদালত।

এই আইনজীবী আরও বলেন, কিছুদিন পর ইসলামী ব্যাংকের আইন উপদেষ্টা আমাকে ব্যাংকে টাকা জমা না হওয়ার বিষয়টি জানান। বিষয়টি মাহিদুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি ট্রেজারি চালান জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। এই ট্রেজারি চালান ছাড়াও তারা পরস্পর যোগসাজস করে সেশন ৪৮৫/২০১৬, সেশন ৫১৫/২০১৬ ও সেশন ৫১১/২০১৬ নং মামলায় ব্যাংকের ট্রেজারি চালান জালিয়াতি করে। একইভাবে চালান ফরম অনুযায়ী টাকা জমা না দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে তারা সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন করিয়ে নিয়েছে। তাদের জামিন জালিয়াতির বিষয়টি জানার পর মামলা দায়ের করি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (সিআইডি) মো. মিজানুর রহমান জানান, ব্যাংকের ভুয়া ট্রেজারি চালান ব্যবহার করে জামিন জালিয়াতি মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ চক্রের বেশ কয়েক জনের নাম জানা যায়। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম রেজা বলেন, জামিন জালিয়াতি এটি একটি মারাত্মক অপরাধ। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারাঙ্গন। আর সেখানে এসে জালিয়াতির মধ্যে পড়বে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আইন অঙ্গনে অবশ্যই এই জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে। এই জালিয়াতির মতো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যাংকের ট্রেজারি চালন জালিয়াতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ট্রেজারি চালন জালিয়াতি বন্ধে আইনজীবীদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। ব্যাংকে টাকা জমার বিষয়টি আইনজীবীদের করতে হবে। এতে একদিকে যেমন জবাবদিহীতা থাকবে অন্যদিকে জালিয়াতি বন্ধ হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আইনবজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন ডলার জানান, এনআই অ্যাক্টের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা আদালতের দেয়া অর্থদণ্ডের অর্ধেক টাকা জমা দিলেই আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন অবেদন করতে পারেন। এ টাকা আত্মসাত করতেই বাদীর পর আদালতের সঙ্গেও প্রতারণা করেন তারা। এতে তারা বিচারক, আইনজীবী ও ব্যাংক কর্মকর্তার সাক্ষর ও সীল নকল করে ভুয়া ট্রেজারি চালান তৈরি করে।