করোনামুক্ত হয়ে ফেরার পর আবার ছুটতে হচ্ছে হাসপাতালে
ঢাকায় গত বছর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন ৩৮ বছর বয়স্ক গণমাধ্যমকর্মী আনিসুর রহমান। কিন্তু তার ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি কর্মক্ষমতা ফিরে পাননি। তিনি বলেন, আমার এই দুর্বলতা দীর্ঘ সময় ধরে চলে। দেখা যায় কিছু দূর হাঁটলে হাঁটুতে ব্যথা করে। যদিও বিশ্রামে আছি এবং যথেষ্ট প্রোটিন খাচ্ছি, তারপরও এই জিনিসটা যাচ্ছে না।
আনিসুর রহমান বলেন, আমি মাঝে মধ্যে অনেক কিছুই মনে থাকে না। ধরেন, বাসার সিকিউরিটি গার্ডকে বললাম, বাসায় আসো পানির কলটা ঠিক করতে হবে। কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে সিকিউরিটি গার্ডকে দেখে জিঙ্গেস করি, কী কারণে এসেছেন? তাকে যে আমি ডেকেছি সেটা ভুলে যাই। আমি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছি।
শুধু আনিসুর রহমান নন, তার মতো অনেকেই করোনাভাইরাস মুক্ত হয়ে ফেরার পর আবার অনেকেই ছুটছেন হাসপাতালে। হাসপাতালের পাশাপাশি মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের চেম্বারেও বাড়ছে লং কভিড ও পোস্ট কভিড রোগীর ভিড়। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোতে লং কভিড রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা সাজানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো হাসপাতালে পোস্ট কভিড ইউনিট চালু করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিডমুক্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর অনেকেরই ১৫ দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে পোস্ট কভিডের প্রভাবে আগের মতোই উপসর্গ দেখা দেয়। কারো শ্বাসের সমস্যা, কারো জ্বর-সর্দি-কাশি দেখা দেয়। এ ছাড়া লং কভিডের প্রভাবে অনেকেরই ঘুমের সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে, কিছুক্ষণের জন্য মনে না থাকা, অল্পতেই ঠাণ্ডা-হাঁচি-কাশি, শরীর ব্যথা, পায়ে ব্যথার উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে তাদের অবশ্যই হাসপাতাল বা মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি এবং সব সময়ের জন্য নিজ নিজ ক্ষেত্রের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা দরকার।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী কেউ যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর - তা গুরুতর বা মৃদু যাই হোকনা কেন - ১২ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও যদি রোগীর দেহে এমন অসুস্থতার লক্ষণ রয়ে যায়, যার কারণ হিসেবে অন্য কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে ধরে নিতে হবে তার 'লং কোভিড' হয়েছে।
ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার তথ্য অনুযায়ী লক্ষণগুলো হচ্ছে: চরম ক্লান্তি বা অবসন্নতা; শ্বাস নিতে কষ্ট বা হাঁপিয়ে ওঠা, হৃৎপিণ্ডের ঘন ঘন স্পন্দন বা বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা বা টানটান ভাব; স্মৃতি শক্তি বা মনঃসংযোগের সমস্যা - যাকে বলা হয় 'ব্রেন ফগ' বা বোধশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া; স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতিতে পরিবর্তন; হাড়ের জোড়ায় ব্যথা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহম্মেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, করোনায় আক্রান্তরা সুস্থ হওয়ার পরও অনেকেই পোস্ট কভিডে আক্রান্ত হয়। তাই আমরা আরো আগেই আমাদের হাসপাতালে আলাদা করে পোস্ট কভিড ইউনিট চালু করেছি এবং সেখানে রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসাও চলছে। অনেকে ভর্তি হয়েই চিকিৎসা নিচ্ছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা পোস্ট কভিড ও লং কভিডের রোগীদের তথ্য পাচ্ছি। এটা বাড়ছেও। পোস্ট কভিডের প্রভাব অনেকেরই ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত চলতে পারে। এর পর ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো ঠিক হয়ে আসতে পারে। এছাড়া লং কভিডে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হার্টের রোগ ছিল তাদের সেগুলো আবার মাঝে-মধ্যেই দেখা দিচ্ছে। ফলে তাদেরও সব সময়ের জন্য নিজ নিজ ক্ষেত্রের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা দরকার। পাশাপাশি তাদের নিয়মিত চেকআপ ও ফলোআপও করতে হবে।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাজী সাইফুদ্দিন বেন্নুর বলেছেন, আমরা এখন প্রতিদিনই পোস্ট কভিডের রোগী পাচ্ছি এবং সেটা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অনেকেরই আগের মতো ফুসফুসের সংক্রমণ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এর যথাযথ কারণ এখনো বলা যায় না। ধারণা করা যায়—কভিড যেভাবে আক্রান্তদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সংক্রমিত করে, তাতে প্রথম দফায় সুস্থ হওয়ার পরও অনেকের ক্ষেত্রে অন্তর্গত ক্ষতির প্রভাব থেকেই যায় এবং দীর্ঘদিন থেকে যাবে হয়তো। এর মধ্যে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সাপেক্ষে কারো উপসর্গ বেশি, কারো কম দেখা দিতে পারে।