পুজোয় বরাদ্দের চাল কেনা ৪০ টাকায়, বিক্রি ২৬ টাকায়!

  • কল্লোল রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুড়িগ্রাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দূর্গা পূজা উপলক্ষে এ বছর কুড়িগ্রামের উলিপুরে ১২২টি মন্দিরে ৫শ কেজি করে মোট ৬১ মেট্রিক টন চাল সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু মন্দির গুলোর কর্তৃপক্ষকে চালের বিপরীতে ডিও লেটার জমা নিয়ে ১৩ হাজার টাকা করে (২৬ টাকা প্রতিকেজি) দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট । অথচ সরকারকে ওই চাল ৪০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়েছে। সে হিসেবে উলিপুরের জন্য প্রকৃত বরাদ্দের প্রায় ৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা কম পেয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। উলিপুর উপজেলা খাদ্য গোডাউন কর্মকর্তা শাহীনুর রহমান এসব তথ্য জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উলিপুর উপজেলায় এবার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ১২২টি মন্দিরে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছরের মত এবছরও সরকারি ভাবে দূর্গা মন্দির কমিটি গুলোকে সহায়তায় করেছে সরকার। এ উপলক্ষে মন্দির প্রতি ৫০০ কেজি করে মোট ৬১মে. টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী প্রতিটি মন্দিরের অনুকূলে ৫'শ কেজি চালের ডিও লেটার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে প্রদান করা হয়।

বিজ্ঞাপন

উপজেলার কয়েকটি মন্দির কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক জানান, গত ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিটি মন্দিরের জন্য বরাদ্দকৃত  ৫'শ কেজি করে চালের ডিও গুলো মন্দির কর্তৃপক্ষের হাতে উপজেলা পরিষদের অডিটরিয়াম সভাকক্ষে স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং খাদ্য নিয়ন্ত্রকের উপস্থিতিতে বিতরণের উদ্বোধন করা হয়। এরপর ডিও গুলোতে মন্দির কতৃপক্ষের স্বাক্ষর নেয়ার পর প্রতিটি মন্দির কমিটিকে চাল ক্রয়কারী সিন্ডিকেট চক্র তের হাজার টাকা করে প্রদান করেন। সিন্ডিকেট চক্রটি সরকারি মূল্যের ৪০ টাকা কেজির চাল ২৬ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে তা বিতরণ করায় কেজিপ্রতি চৌদ্দ টাকা করে হাতিয়ে নেয়। সে হিসাবে প্রতি এক হাজার কেজিতে চৌদ্দ হাজার টাকা। একষট্টি হাজার কেজিতে আট লক্ষ চুয়ান্ন হাজার টাকা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেট চক্র হাতিয়ে নিয়েছে।

উপজেলার পুরিরপটল চৌরাস্তা সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরের সভাপতি কমল চন্দ্র সরকার, হরিবাসর সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরের সভাপতি সুশিল চন্দ্র বর্মন এবং পূর্ব নাওডাঙা ও রাজারাম ক্ষেত্রী পুরাতন দূর্গা মন্দিরের সভাপতি হরেন্দ্র নাথ রায়সহ অনেকে জানান, সরকারি বরাদ্দের চালের পরিবর্তে তের হাজার টাকা করে পেয়েছি। ৭ অক্টোবরের বৈঠকে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। বৈঠকে প্রথমে ৫'শ কেজি চালের বিপরীতে চৌদ্দ হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়ার কথা বলা হলেও পরে ১৩ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়।

বিজ্ঞাপন

তারা উল্লেখ করেন, উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ও সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা ওই দিনের বৈঠকে জানান, সরকারি চালের মান খুব খারাপ, চাল গুলো লালচে, এগুলোর বাজার মূল্য কম হবে, তাই ৫০০ কেজি চালের পরিবর্তে তের হাজার টাকা করে সকল মন্দির গুলোকে দেয়া হচ্ছে। তারা আরও বলেন, আমরা পাশ্ববর্তী উপজেলা গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, সেখানে মন্দির প্রতি সরকারি বরাদ্দের চালের পরিবর্তে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।

 তারা আক্ষেপ করে বলেন, বাজারে চালের মূল্য অনেক বেশি কিন্তু আমাদের তের হাজার টাকা করে নিতে একরকম বাধ্য করা হয়েছে।

উলিপুর শহরে অবস্থিত সন্নাসীতলা দূর্গা মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত দেব ধ্রুব জানান, উপজেলা পরিষদ থেকে ডিও লেটার দেয়ার পর আমাদের নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে      উপজেলা পুজো উদযাপন কমিটি। সেই সভার পর আমাদের ডিও লেটার জমা নিয়ে আমাদের ১৩ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। এবং উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টুর ব্যক্তিগত সাহায্য হিসেবে মন্দির প্রতি ৫০০ টাকা বরাদ্দের অর্থ সহ মোট ১৩ হাজার ৫০০ টাকা পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

এসব চাল ক্রয়কারীদের মধ্যে একজন রেজাউল করিম রাজা। তিনি জানান, চারজন ব্যবসায়ী মিলে ৬১ মে. টন চাল ক্রয় করা হয়েছে। চালের ক্রয় মূল্য অন্য ব্যবসায়ীরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি ২৬ হাজার হাজার সাতশত টাকা করে টন প্রতি কিনেছেন। বর্তমানে বাজারে চালের মূল্য একটু কম বলেও দাবি করেন তিনি।

উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে গবা বলেন, আমরা মন্দির কর্তৃপক্ষের সভাপতি ও সম্পাদকদের হাতে ৫০০ কেজি চালের ডিও তুলে দিয়েছি। চাল নিয়ে কেউ বিক্রি করে দিলে সে বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে সব মন্দির কমিটি চাল বিক্রি করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন কোন মন্দির হয়তো চাল পূজার কাজে ব্যবহার করবেন।

উলিপুর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) শাহীনুর রহমান বলেন, বিষয়টি ব্যবসায়ী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা জানেন। তাদের সাথে কথা বললে বুঝতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আলাউদ্দিন বসুনিয়া জানান, পূজা উপলক্ষে ডিও’র বিপরীতে হাইব্রিড মোটা ভাল মানের চাল সরবরাহ করা হয়েছে। চাল গুলো যে ব্যবসায়ীরা ক্রয় করেছেন, তারা নানান কথা বলে চালের দাম কম দিয়ে থাকতে পারেন। সেখানে তো আমাদের করার কিছু নেই।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহবুবুর রহমান বলেন, পূজা উপলক্ষে সরকারি বরাদ্দের চাল বিক্রয়ের কোন নিয়ম নেই। এর পরেও চাল বিক্রি হয়ে থাকলে বিষয়টি আমার জানা নেই। আর যে চাল সরবরাহ করা হয়েছে তা উন্নত মানের ছিল। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।