মানসিক রোগের ওষুধ সেবনেই ‘উন্মাদ’ হচ্ছিলেন রোগী

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

চা পান করার পরক্ষণেই ‘চা দাওনি’ বলে সঞ্জীব রায় (৭৫) স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা করতেন। বাধ্য হয়ে স্ত্রী তাঁকে একজন মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসকের ওষুধ সেবন করার পর দুই দিন অচেতন হয়ে পড়ে রইলেন সঞ্জীব রায়। যখন তার চেতনা ফিরে এল তখন তিনি আচরণ শুরু করলেন উন্মাদের মতো।

সঞ্জীব রায়ের স্ত্রী কল্পনা রায় বুঝলেন তাঁর স্বামীর ভুল চিকিৎসা হয়েছে। তিনি মামলা করলেন। তদন্তে জানা গেল, এই চিকিৎসকের নামে পাশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে পাঁচটি ডিগ্রি আছে তার কোনো সনদ নেই। অথচ তিনি রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করেছেন। কথিত এই চিকিৎসকের নাম মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে বাবু (৫০)।

বিজ্ঞাপন

মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর নামের পাশে এমবিবিএস, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও কাউন্সিলর, পিজিটি (সাইকিয়াট্টি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ইউএসএস), ইউএসএমএলই (আমেরিকা), এমডি (সাইকিয়াক) আমেরিকা, মানসিক, মাদকাসক্ত এবং সাইকো-সেক্স (যৌন) থেরাপিস্ট পদবী ব্যবহার করতেন। আর চিকিৎসক হিসেবে তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতেন এ-৪০০৫৮।

তাঁর কাছে চিকিৎসায় প্রতারিত সঞ্জীব রায়ের বাড়ি রাজশাহী নগরীর রানিবাজার এলাকার বাসিন্দা। তাঁর স্ত্রী কল্পনা রায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি। তিনি গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ তুলে রাজশাহীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছিলেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তদন্ত শেষে গত ৭ অক্টোবর রাজশাহী পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) দেলোয়ার হোসেন আদালতে মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

তদন্ত কর্মকর্তা জানান, তদন্তকালে বারবার চেষ্টা করেও তিনি চিকিৎসক মোয়াজ্জেম হোসেনের সাক্ষাৎ পাননি। একদিন শুধু ফোনে পেয়েছিলেন। পরে ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনি তদন্ত করে দেখেছেন, ফোনের সিম নম্বরটিও চিকিৎসকের নিজের নয়। নাটোরের গুরুদাসপুর থানার নওপাড়াহাট এলাকার জনৈক আরিফুল ইসলামের নামে সিমটি নিবন্ধিত। সেখানে যোগাযোগ করে এই আরিফুলেরও খোঁজ পাননি। দেলোয়ার হোসেন বলেন, এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া তার নামের পাশের লেখা কোনো ডিগ্রির বিপরীতে কোনো সনদ পাওয়া যায়নি। তদন্তে শেষে তার বিরুদ্ধে রোগীর সঙ্গে প্রতারণা ও চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার বাদী কল্পনা রায় জানান, তার স্বামী ক্ষণে ক্ষণে ভুলে যান। এই নিয়ে তাকে ঝামেলায় পড়তে হয়। এছাড়া তার আর অন্য কোনো সমস্যা ছিল না। তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা পরামর্শ দিলেন হয়তো একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে দেখালে এটা ঠিক হয়ে যেতে পারে। প্রথমবার ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী নগরীর আলুপট্টি এলাকায় অবস্থিত হেপ্টা হেলথ কেয়ার নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক  মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে নিয়ে যান। এই চিকিৎসকের নামে পাশে আমেরিকা থেকে পাওয়া মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন ডিগ্রি দেখে সরল বিশ্বাসে তার কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র নেন। ওষুধ খাওয়ানোর পরে তার স্বামীর দুই দিন কোনো জ্ঞান ছিল না। পরে যখন চেতনা ফিরে পেলেন তখন তিনি বন্ধ উন্মাদের মতো হয়ে গেছেন। এরপরে ২৩ মার্চ তার কাছে নিয়ে গেলে তিনি আরও একটি ওষুধ যোগ করে দেন। দুই বারেই তিনি ১ হাজার টাকা করে ফি নেন। ওষুধে উন্নতি না হওয়ায় কথিত চিকিৎসক মোয়াজ্জেম তাঁর স্বামীকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করার মৌখিক পরামর্শ দেন।

তবে কল্পনা রায় মানসিক হাসপাতালে না নিয়ে শহরের অন্য একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, চিকিৎসক মোয়াজ্জেমের ব্যবস্থাপত্রের মধ্যে তিন ধরনের ঘুমের বড়িই ছিল। চিকিৎসাটা সম্পূর্ণ ভুল। পরের চিকিৎসকের ওষুধ সেবন করে তার স্বামী অনেকটা সুস্থ হন। এ ঘটনায় তিনি প্রথমে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করেন।

এই মামলার শুনানির জন্য নোটিশ করা হলেও মোয়াজ্জেম হোসেন হাজির হননি। সেই মামলা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে তিনি জানতে পারেন যে চিকিৎসকের নামের পাশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে অতিরিক্ত পাঁচটি ডিগ্রির উল্লেখ রয়েছে তার সবই ভুয়া। এই প্রতিবেদন সহকারে তিনি চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগে আদালতে মামলা করেন। গত ৪ জুলাই পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তাঁর তদন্তেও অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্ত মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি রাজবাড়ী জেলা সদরের ভবানীপুর রেলওয়ে কলোনীতে। বাবার নাম আলী আকবর। বর্তমানে রাজশাহী নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় থাকেন মোয়াজ্জেম হোসেন। এই বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর বাবা আলী আকবর দাবি করেছেন, দু’বছর ধরে ছেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। তাঁর ভূয়া ডিগ্রি ব্যবহারের বিষয়েও কিছু জানেন না বলে তিনি জানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মোয়াজ্জেম হোসেন রাজশাহীর বেসরকারি বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক সুজিত ভদ্র বলেন, প্রথমে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে জানা গেল, তাঁর সব ডিগ্রি ভূয়া। সে কারণে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিনি আর এখানে নেই।