কাজে আসছে না ৩৬ লাখ টাকার পুকুর!
পানি সংরক্ষণ ও নিরাপদ পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে চারটি পুকুর পুনঃখননের প্রকল্প গ্রহণ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। আর এ জন্য বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৩৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৪ টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করে সংশ্লিষ্টরা। পুকুরগুলো জেলা পরিষদের তদারকি করার কথা থাকলেও একেবারেই নজরদারি নেই তাদের। বরং উল্টো দুটি পুকুর লীজ প্রদান করে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।
পুকুরগুলো এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। মাছ চাষ, অযত্ন অবহেলা ও তদারকির অভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে পানি। কচুরিপানা আর আবর্জনায় ভরা। এ অবস্থায় প্রকল্পের উদ্দেশ্যে ও কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মাঝে। পুকুর পুনঃখননের ৩৬ লাখ টাকাই যেন জলে। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্তারা বলছেন, বর্তমানে এমন মনে হলেও আগামীতে এটি কাজে লাগবে।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যে ছিল যেসব এলাকার পানিতে লবণাক্ত রয়েছে, সেসব এলাকার মানুষের সুপেয় পানি সরবরাহ করা। পুকুরের গভীরে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখের সময় পানির স্তর ঠিক রাখা এবং ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে উপরিভাগের পানি ব্যবহারে এলাকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।
জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে বালিয়াকান্দি উপজেলায় চারটি পুকুর পুনঃখননের প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের পুকুরগুলো হলো- জঙ্গল ও জামালপুর ইউনিয়নে একটি করে এবং নবাবপুর ইউনিয়নে দুটি। এরমধ্যে প্যাকেজ-রাজ-৫৪ এর আওতায় জঙ্গল ও জামালপুর ইউনিয়নে দুটি পুকুর পুনঃখনন করা হয়। ২০২০ সালের আগস্টের ৬ তারিখে পুকুর খনন সমাপ্ত হয়। প্রতিটি পুকুর খনন বাবদ খরচ ধরা হয় ১২ লাখ ২৮ হাজার ৭৭৫ টাকা।
আর প্যাকেজ- রাজ-১০৩-১ এর আওতায় নবাবপুর ইউনিয়নে দুটি পুকুর পুনঃখনন করা হয়। এই দুটি পুকরের খনন বাবদ খরচ ধরা হয় ৫ লাখ ৫০ হাজার ৯৭৭ টাকা। পুকুর দুটির খনন কাজ সম্পন্ন হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে। চারটি পুকুর খনন বাবদ খরচ হয় ৩৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৪ টাকা।
খননের পর জেলা পরিষদের পরিদর্শনকারী দল পুকুর বুঝে নেন। জেলা পরিষদের গঠিত কমিটি পুকুরগুলোর দেখভাল করার কথা থাকলেও কোন নজরদারী নেই তাদের। ফলে যে উদ্দেশ্যে পুকুরগুলো পুনঃখনন করা হয়েছিল তা সফল হয়নি একটওু। প্রকল্পের এসব পুকুরে পানি সুপেয় রাখতে মাছ চাষ সর্ম্পূণ নিষিদ্ধ বলা থাকলেও জেলা পরিষদ উল্টো পুকুরগুলো লীজ প্রদান করেছে প্রভাবশালীদের কাছে। আর লীজ নিয়ে অবাধে চলছে মাছ চাষ।
সরেজমিন নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী গ্রামের দোপপাড়ার পুকুরে গিয়ে দেখা যায়, পুকুরটি শুকিয়ে গেছে। মাঝখানে কোন রকম হাটু পানি রয়েছে। তদারকির অভাবে পুকুরের চারপাশের কাটাতারের বেড়া ও পিলার ভেঙে পড়ে আছে। পুকুরটি স্কুল শিক্ষক আবুল কালাম মন্ডল লীজ নিয়ে মাছ চাষ করছেন। তিনি জানান, পুকুরটি খননের পর প্রথম দুই বছর এভাবে পড়ে ছিল। কেউ ব্যবহার করতো না। পরে আমি ২০২৩ এ জেলা পরিষদ থেকে লীজ নিয়ে মাছ চাষ করছি।
জামালপুরের তুলসী বরাট গ্রামের পুকুরটি কচুরিপানা ও আবর্জনায় ভরা। পুকুরের পাশের বাসিন্দা শংকরী বিশ্বাস বলেন, পুকুরটি শুধু শুধু খনন করা হয়েছে। এটি আমাদের কোন কাজেই আসছে না। বারো মাস কচুরিপানায় ভরে থাকে। পাটের সময় পুকুরের মধ্যে পাট জাগ দেওয়া হয়। যেখানে পাট জাগ দেওয়ার হয় সেখানে কতটুকু সুপেয় থাকতে পারে পানি?
জঙ্গল ইউনিয়নের পুকুরটির অবস্থা আরো শোচনীয়। পুকুরটি এখন আর কেউ ব্যবহারই করছেন না বলে জানান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কল্লোল বসু। তিনি বলেন, তদারকির অভাবে পুকুরটি এখন পরিত্যক্ত। যে উদ্দেশ্য নিয়ে খনন করা হয়েছিল তা একটওু সফল হয়নি। এখানে লাখ লাখ টাকাই জলে গিয়েছে।
জেলা পরিষদের বালিয়াকান্দিতে দায়িত্বরত সদস্য মো: আব্দুল বারিক বিশ্বাস বলেন, পুকুরগুলো ২০২০ সালের শেষের দিকে খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৩ সালে আমি ও পরিষদের চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। বিষয়টি দ্রুত খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুটি পুকুর লীজ দেওয়া হয়েছে বলে আমি জানতে পেরেছি।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য সহকারী প্রকৌশলী মো: রেজাউল করিম বলেন, প্রথমত পুকুরগুলো সরকারের দখলে ছিল না। পুনঃখননের মাধ্যমে দখলে চলে আসে। যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে এটি একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। অদূর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় রেখে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ হয়ত এটির উপকারিতা চোখে পড়ছেনা। কিন্তু ৫০ বছর পর যখন পানির স্তর নিচে নেমে যাবে তখন এই পুকুরগুলো মানুষের ভীষণ কাজে লাগবে।