পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সাকিবরা এখন শিশু শ্রমিক
২৫ মার্চের দুপুরবেলা। কুড়িগ্রাম শহরের অদুরে ধরলা ব্রিজের পাশের চর আরাজি পলাশবাড়ী। স্থানীয় চাষি মো. শাহিদুল ইসলামের সবজি ক্ষেতে দিনমজুরের কাজ করছে একদল শিশু। দূর থেকে দেখে কারও বয়স ১৮ এর বেশি মনে হয়নি। কাছে গিয়ে কথা বলে এর প্রমাণও পাওয়া গেলো। তাদের মধ্যে একজন সাকিব ইসলাম (১৫) সাথে তার বড় ভাই লিজান রানাও (১৭) এসেছেন কাজে। ভর দুপুরে স্কুলে না থেকে ক্ষেতে কেন কাজ করছেন এমন প্রশ্নের লাজুক মুখে সাকিবের জবাব, অভাবে স্কুলে যাইনা।
শুধু সাকিব ও তার বড় ভাই নয়। তাদের মতো ১০-১২ জন শিশুর একটি দল কয়েকমাস ধরে কাজ করছেন স্থানীয় চাষি শাহিদুল ইসলামের ক্ষেতে। কারও কারও ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা কয়েক বছরের। সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খেটে অভিজ্ঞতা ও বয়স ভেদে দৈনিক সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা মজুরি পায় তারা। তাদের দলের সবাই কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চর মাধব রাম সর্দার পাড়া গ্রামের বাসীন্দা।
সাকিবদের এই দলে সবচেয়ে কম বয়সের শিশু মো. রাকিবুল ইসলামের বয়স ১৩ বছর। কাগজে কলমে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী হলেও পড়াশোনায় সে অনিয়মিত। তার বাবা শহিদুল ইসলাম নদীতে মাছ শিকার করে যা আয় করেন তা দিয়েই চলে সংসার। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বেড়েছে সংসারের অভাব। তাই গত ২ মাস থেকে এলাকার বন্ধুদের সাথে চরের ক্ষেতে এসেছে দিনমজুরের কাজে। তার মজুরি দৈনিক ২০০ টাকা। ৫০ টাকা নিজের কাছে রেখে বাকীটা মায়ের হাতে তুলে দেয় সে।
এই দলের বড়ভাই হিসেবে পরিচিত মাসুদ রানার (১৮) দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা। ভোগডাঙ্গা এ.কে উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া তার। ২০২৩ সালের পর থেকে স্কুলে যায় না মাসুদ।
মোবাইল ফোনে কথা হয় মাসুদের মা মোছ. মোমেনা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, করোনার পর স্কুল খুললে আমার ছেলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এসএসসি পাশ করার জন্য অনেকবার বললেও শোনেনি সংসারে অভাব। তাই ছেলেকে কাজে পাঠাই। নাহলে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতো।
সাকিব, রাকিবুল ও মাসুদের মতো তাদের দলের আলামিন(১৭), নাজমুল(১৮), রহিম(১৭), বিপুল(১৬), হাসানদের(১৫) নিজের ও পরিবারের গল্প একই রকম। কাগজে কলমে স্কুলের খাতায় নাম থাকলেও এরা কেউ এখন স্কুলের শিক্ষার্থী নয়।
শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে ও ঝড়ে পড়া ঠেকাতে উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জেলা কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলার শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপবৃত্তির আওতায় এনেছে সরকার। কুড়িগ্রাম সদর, চর রাজিবপুর, চিলমারী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ের শিশুদের স্কুল মুখী না হয়ে শিশু শ্রমে ঝুঁকে পড়ার এমন চিত্র সরকারের এমন উদ্যোগকে ম্লান করে দিচ্ছে।
দিনমজুর শিশুদের দলটির মধ্যে প্রাথমিকের গন্ডি পেরোনো শিশুরা অধিকাংশই ভোগডাঙ্গা এ.কে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি ছিলেন। বিদ্যলয়টির প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেন বলেন, আমরা চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার। কিন্তু অবিভাবকদের অসচেতনতার কারনে সেটি সফলভাবে করা যাচ্ছেনা। নিয়মিত অবিভাবক সমাবেশে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের অবিভাবকরাই অনুপস্থিত থাকেন। তারপরও অবিভাবকদের দেখা পেলে তাদের বাচ্চাদের নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর জন্য বলা হয়। এসব চেষ্টা করার পরেও প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ছে বলেও জানান তিনি।
সুবিধাবঞ্চিত ও ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসছেন কুড়িগ্রামের যুবক অন্তু চৌধুরী। এসব শিশুদের জন্য মন রঙ্গের পাঠশালা নামে একটি পাঠাশালা খুলেছেন তিনি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, বাচ্চারা স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার পেছনে যেমন অবিভাবকদের দায় আছে, তেমনি পড়াশোনার ব্যবস্থাপনারও দায় আছে। অধিকাংশ অবিভাবক চায়না তাদের বাচ্চা পড়াশোনা না করে কাজে যাক। কিন্তু বর্তমানে স্কুল গুলোতে বিনোদনের মাধ্যমে পাঠদানের কোন ব্যবস্থা নাই। শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেয় না। ফলে বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এরপর বাচ্চাদের বসিয়ে না রেখে কাজে পাঠায় বাবা-মা। আবার কিছু অবিভাবক শিক্ষার যথাযথ গুরুত্ব না বোঝার ফলে তারা দ্রুত নগদ অর্থ লাভের আশায় বাচ্চাদের কাজে পাঠায়।
তিনি আরও বলেন, ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমানোর জন্য শিক্ষকরাও খুব একটা আগ্রহ দেখান না। বাচ্চারা কেন ঝড়ে পড়ছে এবং কেন শিশু শ্রমে নিযুক্ত হচ্ছে সেব্যাপারে খোঁজ নেয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের আগ্রহও চোখে পড়েনা। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সম্মিলিত যথাযথ উদ্যোগের ফলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।