স্থাপত্যশৈলীর প্রাচীন নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী মিয়াবাড়ি মসজিদ

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

স্থাপত্যশৈলীর প্রাচীন নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী মিয়াবাড়ি মসজিদ

স্থাপত্যশৈলীর প্রাচীন নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী মিয়াবাড়ি মসজিদ

স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বরিশালের ঐতিহ্যবাহী মিয়াবাড়ি মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদ শুধু বরিশালের নয়, বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম। বরিশাল সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার উত্তর কড়াপুর গ্রামে অবস্থিত দ্বিতল এ মসজিদটি নির্মিত হয় ব্রিটিশ আমলে। মনে করা হয়ে থাকে, ১৮শ শতকে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এখনো নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয় মসজিদটি। বর্তমানে দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর পর্যটক ঘুরতে আসে মোগল আমলে নির্মিত বরিশালের এ ঐতিহ্য মিয়াবাড়ি মসজিদ দেখতে।

ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তৎকালীন মাহমুদ হায়াত এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের সাথে দুটি বিশালাকার দীঘি খনন করেন। যা মসজিদের সৌন্দর্যকে নয়নাভিরাম করে তুলেছে। মসজিদটি লম্বায় প্রায় ৭০ ফুট এবং প্রস্থে ৪০ ফুট। বলা হয় চুন, সুরকির সঙ্গে মাষকলাই ও চিটাগুড় পচিয়ে এর নির্মাণসামগ্রী তৈরি করা হয়েছিল। এর অন্যতম নির্মাণবৈশিষ্ট্য হলো, ছাদে কোনো ধরনের রড কিংবা লোহার ব্যবহার হয়নি। ইট, সুরকি ও চুনের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি ছাদের পুরুত্ব প্রায় এক ফুট। মসজিদটি দ্বিতলবিশিষ্ট ও সম্পূর্ণ কারুকার্যমণ্ডিত। মূল মসজিদের সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে দ্বিতীয় তলায়। নিচতলায় রয়েছে ছয় দরজা বিশিষ্ট আবাসন ব্যবস্থা। যেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয়েছে থাকার ব্যবস্থা। মসজিদের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে তিনটি দরজা।

বিজ্ঞাপন

ছাদের মাঝখানে রয়েছে বড় তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি সবচেয়ে বড়। ভিতরের অংশেও রয়েছে কারুকার্যময় সুন্দর নকশার সমাহার। চারপাশে পিলারের ওপর নির্মিত হয়েছে আটটি বড় মিনার। বড় মিনারগুলোর মাঝে রয়েছে ১২টি ছোট ছোট মিনার। ছোট মিনারগুলোর মাঝের স্থানকে সুন্দর কারুকার্যময় নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে। মসজিদের দ্বিতীয় তলায় উঠার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ির নিচে দুটি বাঁধানো কবর রয়েছে। কিন্তু ওই কবর কাদের সেটা জানেন না এলাকার মানুষ।

আবুল কালাম আজাদ নামের স্থানীয় এক মুসল্লি বার্তা২৪.কমকে বলেন, হায়াত মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি মিয়াবাড়ি মসজিদের প্রতিষ্ঠা করেন বলে আমরা জানি। তৎকালীন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নির্বাসিত হন তিনি। এ সময় তার জমিদারিও কেড়ে নেওয়া হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে ফিরে তিনি এলাকায় দু’টি দীঘি ও দ্বিতল এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মোগল আমলের এ স্থাপনাটি দেখতে অনেক মানুষই ছুটে আসেন। কিন্তু যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সড়কটি সংস্কার না করায় যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

বিজ্ঞাপন

কড়াপুর মিয়াবাড়ি জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মো. জামাল উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি প্রায় ৩৩ বছর ধরে এই মসজিদে ইমামতি করে আছি।  আমাদের পূর্বপুরুষ ও মুরুব্বিগণ বলে থাকেন এটি মোগল সম্রাটের সময় এটি নির্মাণ করা হয়েছে। আনুমানিক ৭শত বছরের আগে এটা তৈরি করা হয়েছে।


তিনি বলেন, বর্তমানেও মিয়া বাড়ির যে বংশধর তারাই এই মসজিদটি এখনো পরিচালনা করে থাকেন। এই মসজিদটি সিঁড়ির নিচে দুইটি কবর রয়েছে। তবে কেউ জানেন না এ কবর দুটি কাদের। তবে ধারণা করা হচ্ছে যারা এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা তাদের স্বামী-স্ত্রীদের দুইজনের এ কবর; আবার বলা হয়ে থাকে মাহমুদ হায়াত ও মাহমুদ জাহিদ তাদের  দুই ভাইয়ের কবর। যারা এই মসজিদটি তৈরি করেছে তারা খুব ভালো মানুষ ছিল। সেই সময় তারা মনে করছিল এই মসজিদের দোতলায় উঠতে হলে সিঁড়ির নিচে তাদের কবর থাকলে অনেক আল্লাহর ওলি বুজুর্গ এখানে পদচারণা করার কারণে আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন, এমনটা মনে করে মানুষ। এ মসজিদটিতে এক সাথে একশ মানুষের অধিক নামাজ আদায় করতে পারে। ২০১৩ সালে এটা কিছু সংস্কার করা হয়েছিল। এখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন ও অনেকেই নামাজ আদায় করেন।

মসজিদটি দেখতে আসা রাহাত রাব্বি নামের এক দর্শনার্থী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার জীবনের প্রথম কোন পুরানো দিনের জিনিস দেখলাম, যা এত কারুকার্যের নকশা করা! এখানে এসে জামাতে নামাজ আদায় করলাম। বাহিরে গরম থাকলেও মসজিদের ভিতরে অনেক ঠান্ডা।


জমিদারি মিয়া বাড়ির বংশধর মো. মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে জানান, ইসলাম প্রচারের জন্য পারস্য দিয়ে এসে মাহমুদ হায়াত ও মাহমুদ জাহিদ এই মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তাদেরও পূর্বপুরুষ এই জায়গায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। এখানে দুইটা বাড়িতে আমরা তাদের ১৩তম বংশধর। তারা এই দেশের শাসন করেছিল ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নির্যাতিত হয়েছিল। অমিতপুরে তাদের আরও একটি জমিদারি ছিল। দ্বীপান্তরে নিয়ে ব্রিটিশরা অনেক মানুষকে যাবজ্জীবন দিয়েছিল, হত্যা করেছিল। আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে শুনেছি পরবর্তীতে তাদের এক শাসক মাহমুদ জাহিদের মুক্তির জন্য বাঁশি বাজিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। তারপর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই 'মিয়া' উপাধি ব্রিটিশরাই দিয়েছে। আমাদের পূর্বের বংশের লোকেরা আসলে আগে ছিল 'মালদার খান'। ব্রিটিশদের দেওয়া নামেই থেকেই 'মিয়া' উপাধি আমাদের বংশধররা ব্যবহার করে আছে। আমার আপন বড় চাচাও আব্দুল মান্নান মিয়াও জমিদারি করেছেন। তারপর  শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সময় জমিদারি প্রথা স্থগিত হয়। আমাদের জমিদারী চলে যায়।


তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে আমাদের কিছুটা সমস্যা হয়েছিল তখন আমার বড় চাচা আব্দুল মান্নান মিয়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে এটি কিছুটা সংস্কার করেন। তারপর আমার ভাই আবার হাইকোর্টের রিট করে এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এনে ২০১৩ সালে আমারা এককভাবে সংস্কার করি। দেশ বিদেশ থেকে হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নিদর্শন দেখতে আসেন। বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ও ভারতের রাষ্ট্রদূত এই মসজিদটি পরিদর্শন করেছিলেন। এছাড়াও দেশের বেশ কয়েকটি দেশের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এখানে এসেছিলেন।