প্রধানমন্ত্রীর কাছে বুয়েট শিক্ষার্থীদের খোলা চিঠি
![ছবি: সংগৃহীত](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2024/Apr/02/1712068698893.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
মেধাবীদের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সন্ধ্যায় বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রেস ব্রিফিংয়ে এই চিঠি পাঠ করেন শিক্ষার্থীরা।
চিঠিতে শিক্ষার্থীরা বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকে স্বৈরাচার পত্তন আন্দোলনে এই দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অথচ বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মত ঘটনা এবং এর ব্যাপ্তি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ৯৯ এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল ০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল'১৭ এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি।
তারা বলেন, বুয়েটে আরো অসংখ্য শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে। দাপটের আড়ালে ছাত্ররাজনীতি আমাদের ক্যাম্পাসে উন্মুক্তভাবে বিচরণের অধিকার, ক্যাম্পাসের সুস্থ অ্যাকাডেমিক পরিবেশ, আমাদের স্বাধীনতা, হলের মেসের টাকার সৎ ব্যবহার, ক্যাম্পাস মাদকমুক্ত থাকা, নবীন আগত বুযেটিয়ানদের একটি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন উপভোগ এর অধিকার সবকিছুই হারিয়ে গিয়েছিল। ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও রুখে দিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ।
শিক্ষার্থীরা বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বরাবরই একটি নিরাপদ এবং সুস্থ ক্যাম্পাস চেয়ে এসেছে যেখানে ক্ষমতাচর্চার লোভ-লালসার শিকলে আবারো জিম্মি হয়ে যাবে না সকলের নিরাপত্তা, শিক্ষাঙ্গনের উপযুক্ত পরিবেশ। সুস্থ নেতৃত্ব এবং নৈতিকতা বিকাশের সকল উপাদান ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির উপস্থিতি ব্যতীতও গত কয়েক বছরে উপস্থিত ছিল এবং এতে সুস্থ নেতৃত্বের চর্চায় শিক্ষার্থীরা তাদের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে। বর্তমানে বুয়েটে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ থাকায় নিজ জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণামুখী কাজে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য সারাদেশব্যাপী জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে। রাজনীতিমুক্ত বুয়েট ক্যাম্পাসের গত ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের সকল সফলতা জানান দেয়, আমরা আমাদের বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ব্যতীতও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব গঠন এবং বিকাশ প্রয়োজন, তা করতে পারি, স্মার্ট বাংলাদেশ এর লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিরন্তর কাজ করে যেতে পারি।
মৌলবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে তারা বলেন, আমরা দেশের যেকোনো স্থানের ন্যায় আমাদের ক্যাম্পাসকে আমরা অবশ্যই যেকোনো প্রকারের সন্ত্রাস, মৌলবাদ বা নিষিদ্ধ গোষ্ঠী থেকে নিরাপদ রাখতে সর্বদা তৎপর। সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেক মহল থেকেই বলা হচ্ছে যে, ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ মৌলবাদী বা সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রম বিদ্যমান এবং এর ফলশ্রুতিতেই তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির চর্চার পক্ষে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আপনাকে নির্দ্বিধায় বলতে চাই, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যদি যেকোনো মুহূর্তে এসকল নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যেকোনো কার্যকলাপ ক্যাম্পাসে চলমান দেখি শীঘ্রই তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান দিব এবং প্রশাসনকে অবহিত করব। এমনকি ভবিষ্যতে যদি ক্যাম্পাসে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সেটার বিরুদ্ধেও আমাদের অবস্থান দৃঢ়।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, চার বছর আগে আপনার দৃঢ় এবং দ্রুত হস্তক্ষেপে আমরা নতুন করে এই ক্যাম্পাসে বাঁচতে শিখেছি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই ছোট্ট একটা চাওয়ার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি হুমকি, হচ্ছি লাঞ্ছিত, অপদস্থ। আমরা, আমাদের ছোট ভাই বোনেরা আরও একবার সেই অন্ধকার দিনগুলোর সাক্ষী হতে চাইনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সকল সময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন, আমরা জানি এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না। বুয়েটকে ঘিরে আমাদের জাতির জনকের যে ভিশন ছিল, তাকে বাস্তবায়ন করা হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন বুয়েটের প্রকৃতি ভিন্ন। তাই তিনি নিজে রাজনীতির আওতা থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাইরে রেখেছিলেন। আজ যখন তাঁরই গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বুয়েটের মতো বিশেষায়িত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যেকোনো মূল্যে রাজনীতির আওতায় আনার কথা বলে, আমরা বিশ্বাস করি তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও সিদ্ধান্তকে অপমান করা হয়।
প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, বুয়েটকে নিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে পলিসি গ্রহণ করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন করুন। বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখুন, প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও। কারণ সুবিচারের জন্যই আইনের সৃষ্টি। আমাদের অনুরোধ, আপনি দয়া করে আমাদের ক্যাম্পাসে আসুন: ছাত্ররাজনীতিহীন বুয়েট গত কয়েকবছর ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য যে আদর্শ ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে, সেটা আমরা আপনাকে দেখাতে চাই।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও দফতর সম্পাদকসহ অনেকের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশকে কেন্দ্র করে রাজনীতি প্রতিরোধে আন্দোলন শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাসে প্রবেশে সহযোগিতায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বির হলের সিট বাতিলসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ও ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি পুনরায় চালুর দাবিতে ছাত্রলীগ এক প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে এবং নেতাকর্মী নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে প্রবেশ করে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে। এরপর সবশেষ, গত সোমবার বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিজ্ঞপ্তি স্থগিত ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। দেশের শীর্ষ এ প্রকৌশল উচ্চশিক্ষালয়ে ছাত্ররাজনীতি চলতে বাধা নেই বলে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামানের বেঞ্চ আদেশ দেন।