রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সাইফুল ইসলাম সদ্য কৈশোর ছেড়ে তারুণ্যে পা রেখেছেন। এই সময়ে পড়াশোনা আর বন্ধুদের সঙ্গে হৈহুল্লোড় করে জীবন উপভোগ করার কথা। তবে অন্য আর দশটি ছেলের মতো স্বাভাবিক জীবনে নেই সাইফুল। বরং অপরিচিত এক রিকশাচালকের খপ্পরে মাদকের অন্ধকারে পথ হারানো তার সময় কাটছে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লড়াইয়ে।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে রাস্তায় অপরিচিত এক রিকশাচালকের সঙ্গে সখ্যই কাল হলো সাইফুলের। রিকশাচালকের ছদ্মবেশে থাকা ওই ব্যক্তি ছিলেন মাদকের ডিলার। তার প্ররোচনায় মাদক গ্রহণ ও একটা পর্যায়ে মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে যান স্কুলপড়ুয়া সাইফুল। গাঁজা-ইয়াবা থেকে শুরু করে দেশের অপ্রচলিত মাদক কোকেনে আসক্তিতে জড়ান। ফলে মাদকের থাবায় পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়তে হয়। এমনকি পরিবার সুস্থ করে তুলতে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করলেও একাধিকবার মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে পালিয়েছেন। বেশ কয়েকটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের পরে সাইফুলের ঠিকানা এখন গাজীপুরে আহছানিয়া মিশন পরিচালিত মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
গত ৯ মে আহছানিয়া মিশনের মাদক পুনর্বাসন গাজীপুর কেন্দ্রে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সাইফুলের। তার ভাষ্যে জানা যায়, বাবা প্লাস্টিক ব্যবসায়ী। লালবাগ এলাকা একটি স্কুলে পড়তেন। কিন্তু মাদকের কারণে সপ্তম শ্রেণির পর ঝড়ে পড়েন সাইফুল। এরপর মাদকাসক্তি ও নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসায় কাটছিল তার জীবন।
মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে সাইফুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, লালবাগের একটি স্কুলে পড়াশোনা করতাম। সব সময় আমার পরীক্ষার ফলাফল ভালো হতো। প্রাথমিকে পড়ার সময় থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে ধূমপান করতাম। হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে এক রিকশাচালক ডাক দিলো। কাছে যেতেই নানাভাবে সখ্য গড়ে তুলল। এরপর আমাকে গাঁজা সেবনের প্রস্তাব দিলো। এক টান দিতেই আমার মাথা ঘুরে গেলো। সে দিন রাস্তায় অনেক বমি করেছিলাম। পরে সেই রিকশাচালক আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। এরপর আমি নিজেই ওই রিকশাচালকের কাছে যেতাম। বাসা থেকে টাকা নিয়ে নিয়মিত গাঁজা সেবন করতাম।
কিন্তু হঠাৎ একদিন টাকা না থাকায় মাদক চাইলে সেই রিকশাচালক আমাকে মাদক বিক্রির প্রস্তাব দেয়। টাকা জোগাতে এরপর ওই রিকশাচালকের ইয়াবা বিক্রি করতাম। এভাবে ধীরে ধীরে আমি ইয়াবা সেবন শুরু করি। মাদকের টাকা জোগাতে বাসায় চুরি শুরু করি। টাকা না পেলে জিনিসপত্র চুরি শুরু করি। বিষয়টি টের পেয়ে আমার পরিবার ডোপ টেস্ট করায়। পরবর্তীতে মাদকাসক্তির প্রমাণ পেয়ে তেজগাঁও এলাকায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করায়। ২৮ দিন করে দুই দফায় নিরাময় কেন্দ্রে থাকার পরেও মাদক থেকে ফিরতে পারিনি।
ইয়াবা ও গাঁজা সেবন থেকে ফিরতে ভর্তি হন নিরাময় কেন্দ্রে। সুস্থ হওয়ার বদলে জড়িয়ে যান হিরোইন ও কোকেনের মতো মাদকে উল্লেখ করে সাইফুল আরও বলেন, তেজগাঁওয়ের সেই মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা চলাকালীন কেন্দ্রের নারী শাখায় ভর্তি থাকা একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। মোহাম্মদপুর এলাকার সেই মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে হিরোইন সেবন শুরু করি। সেই মেয়ের মাধ্যমে তার সঙ্গে হিরোইন বিক্রি করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে আমরা সেবন করতাম। এরপর সেই মেয়েই আমাকে কোকেন সেবন করায়। এক গ্রাম কোকেনের দাম পাঁচ হাজার টাকা। বাসা থেকে টাকা চুরি করে কোকেন সেবন করতাম। এমনকি টাকা না পেয়ে মায়ের ওয়াশিং মেশিন বিক্রি করে দিই। পরবর্তীতে পরিবার রায়েরবাজার এলাকার একটি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে। সেখান থেকে কেন্দ্রের লোকজনকে মারধর করে পালিয়ে যাই।
তিনটি প্রতিষ্ঠানে চারবার চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ হতে পারেননি সাইফুল। এমনকি দুটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্য বন্দিদের সঙ্গে মিলে নিরাময় কেন্দ্রের কর্মীদের মারধর করে পালিয়ে যান।
সর্বশেষ গত কয়েকমাস ধরে আহছানিয়া মিশনের পরিচালিত গাজীপুর কেন্দ্রে মাদক ছেড়ে জীবনের পথে ফেরার চিকিৎসা গ্রহণ করছেন সাইফুল। এখন তার ভুল ভেঙেছে। জীবনের শুরুতে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া সাইফুল চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। নতুন করে পড়াশোনা করে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতেন চান ১৮ বছরে পা দেওয়া এই তরুণ।
জানা গেছে, আহছানিয়া মিশনের রাজধানীসহ দেশের তিন জেলায় নারী ও পুরুষদের মাদক মুক্ত করতে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করছে। ২০০৪ সালে গাজীপুর জেলার গজারিয়া পাড়া এলাকায় প্রাকৃতিক ও মনোরম পরিবেশে মাদকাসক্তি মুক্ত করার চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালে যশোরে, ২০২১ সালে মুন্সিগঞ্জ ও রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এই সকল নিরাময় কেন্দ্র মাদকের কারণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বহু মানুষের জীবনের আলোর বাতিঘর হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আহছানিয়া মিশন পরিচালিত মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৭৮৯ জনকে সেবা নিয়েছেন। ২ হাজার ৭৮৯ জন চিকিৎসা গ্রহণকারীর মধ্যে মাদকাসক্তজনিত সমস্যা দুই হাজার ১৪২ জনের এবং মানসিক সমস্যা ৬৪৭ জনের। যার মধ্যে এ পর্যন্ত সুস্থতার হার প্রায় ৭৫ শতাংশ।
ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ বলেন, আমরা তিন ধরনের রোগীকে সেবা দিয়ে থাকি। যেমন মাদকাসক্তি, আচরণগত এবং মানসিক সমস্যা। ৬ মাসের একটি কোর্সের আওতায় সেবা দেওয়া হয়। যারা পূর্ণমেয়াদে চিকিৎসা নিয়েছেন, পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হলে তারা ১২ দিন বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও কাউন্সেলিং সেবা নিতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের গাজীপুরের এই কেন্দ্র থেকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি ধাপে চিকিৎসা সেবা হয়। আমার কেন্দ্রগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে সাধারণ স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, নিয়মিত চেকআপ, রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও নিয়মিত বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসকের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করা হয়।