রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর কয়েক কোটি মানুষের স্বল্প মূল্যে চিকিৎসার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এটি। প্রতিদিন দিন প্রায় কয়েক হাজার মানুষ চিকিৎসা নেয় হাসপাতালটিতে। শুধুমাত্র বহির্বিভাগেই চিকিৎসা নেয় অন্তত ২০ হাজার মানুষ।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ কম খরচে চিকিৎসা সেবা নিতে আসলেও এ হাসপাতালে নানা ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও স্বজনরা। হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ওষুধ সংকট, ডাক্তার সংকটের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা নিরীক্ষায় পোহাতে হয় ভোগান্তি। অতিরিক্ত টাকা নেওয়া, পর্যাপ্ত ওষুধ না দেওয়া, স্যানিটেশন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভিযোগ আছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ।
এছাড়া দালাল ও সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। পাশাপাশি সিট বাণিজ্য, রোগীর সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ ও অর্থের বিনিময়ে ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের দৌরাত্ম্যে সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে। আনসারদের সাথে সিন্ডিকেটে জড়িয়ে আছে আউটসোর্সিং ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা বলেও অভিযোগ আছে সেখানে।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে টিম বার্তা২৪। খোঁজ নিয়ে মেলে হাসপাতালটির বিভিন্ন সংকট ও সমস্যার চিত্র। সাথে সিন্ডিকেট ও দালালের দৌরাত্ম্যের চিত্রও ওঠে আসে অনুসন্ধানে।
সংকটে জর্জরিত সোহরাওয়ার্দী
দেশব্যাপী চিকিৎসা জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া ও দক্ষ ডাক্তার গড়ে তোলার জন্য ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় হাসপাতালটি। গেল বছরে ৮৭৫ শয্যা থেকে উন্নীত হয়ে ১৩৫০ শয্যার সেবা দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালটিতে।
ঢাকা ও আশপাশের বেশিরভাগ জেলার কয়েক কোটি মানুষের বিপরীতে ১৩৫০ সিট হওয়ায় সব সময় সিট সংকট থাকে হাসপাতালটিতে। এছাড়া চিকিৎসার ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ওষুধই মেলে না হাসপাতালে। ফলে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে রোগীদের। অ্যান্টিবায়োটিক, স্যালাইন, ইনজেকশনসহ বেশ কয়েক ধরনের ওষুধ সংকট আছে হাসপাতালটিতে।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, প্যারাসিটামল, নাপা, গ্যাসের ওষুধ ছাড়া বেশিরভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে বাঁচা তো দূর, এমন সংকটে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে তাদের।
মায়ের অপারেশনের জন্য ১০ দিন ধরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আছেন নোয়াখালীর জিসান। প্রথমদিন ভর্তির পরেই প্রায় ১৮ হাজার টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে তাকে।
জিসান বলেন, আমার মায়ের অপারেশন। কম খরচ হবে ভেবে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসেছি চিকিৎসা নিতে। এখানে এসে আরও বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। সব জায়গায় দুর্নীতি। টাকা দিলে সেবা মেলে। ওষুধ শুধু নাপা দেয়। যে ওষুধের দাম বেশি সেটাই স্লিপ ধরায় দিয়ে বলে বাইরে থেকে আনতে। প্রথম দিন এসেই আমার ১৮ হাজার টাকার ওষুধ কেনা লাগছে। আমরা তো অসহায়।
ফাতেমা নামের এক নারী জানান, বাবাকে নিয়ে ১৬ দিন ধরে আছি হাসপাতালে। বেশিরভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। প্যারাসিটামল ও গ্যাসের ট্যাবলেট দিচ্ছে এখান থেকে। ওষুধ নাকি সাপ্লাই নেই বলে। থাকলেও দেয় না, নাকি জানি না।
এদিকে, কাগজেকলমে হাসপাতালটিতে ৩২৫ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছে ২৯৮ জন। ডাক্তার সংকট আছে হাসপাতালটিতে। এতে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে হাসপাতালের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসক দিয়ে সেবা দিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ বলছে বিপুল জুনিয়র ডাক্তার প্রয়োজন হাসপাতালে।
নন-মেডিকেল কর্মকর্তা ৩ জন, উপ-সেবা তত্ত্বাবধায়ক ১ জন, নার্সিং সুপারভাইজার ৩ জন, সিনিয়র স্টাফ নার্স ১২ জন, স্টাফ নার্স ৪ জনসহ মোট ২৩ জন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির ১০১ জন কর্মচারীর সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকট থাকায় টয়লেট ও বহির্ভাগের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। নোংরা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে হাসপাতালের নিচতলার বেশিরভাগ টয়লেট। পুরুষ ও মহিলার ওয়ার্ডের কিছু টয়লেটেও দেখা গেছে একই চিত্র। এছাড়া বাহিরে রোগী অপেক্ষার বেঞ্চের পাশেই রাখা হয়েছে ডাস্টবিন। ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার না করায় গন্ধ ছড়াচ্ছে। তবে ওয়ার্ডগুলোতে স্বাভাবিক পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে।
অন্যদিকে হাসপাতালে ভিতর ও বাহিরের বেশিরভাগ ড্রেনের অবস্থা নাজুক। ময়লা পানি ও আবর্জনা জমে গেছে। এতে ডেঙ্গু ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের বেডের কাপড় অপরিষ্কার ও ছারপোকার উপদ্রব আছে হাসপাতালে এমন অভিযোগও করেছেন রোগীরা।
আবু বক্কর নামের এক রোগীর স্বজন বলেন, হাসপাতালের টয়লেটের অবস্থা খুব খারাপ। ওয়ার্ডের পরিবেশ ভালো থাকলেও টয়লেট ব্যবহার করা যায় না। এছাড়া বিছানায় ছারপোকার জন্য রাতে রোগীরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। মাসে অন্তত একবার বিছানাপত্র পরিষ্কার করা উচিত।
টাকা দিলে মেলে সিট, টাকা ছাড়া মেলে না হুইল চেয়ার ও স্ট্রেচার সেবা
বহু চাহিদার বিপরীতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালে মাত্র ১৩৫০ সিট থাকায় সব সময় পূর্ণ থাকে বরাদ্দের সিট। তবে দালাল মারফতে টাকা দিলে সংকটের মধ্যেও ব্যবস্থা হয় সিটের। এছাড়া টাকা ছাড়া হাসপাতালে মেলে না ট্রলি, স্ট্রেচার ও হুইল চেয়ার সেবা।
রোগীর স্বজন সেজে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে টিম বার্তা২৪। মূলত সিট বাণিজ্য ও সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের সহযোগিতা করেন এই ট্রলি ও হুইল চেয়াররের দায়িত্বে থাকারা। আড়াল থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে আনসার সদস্যরা। তাদের সাথে জড়িত হয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব থাকা কর্মচারীরা।
হাসপাতালে বিনামূল্যে স্ট্রেচার ও হুইল চেয়ার সেবা মেলার কথা থাকলেও। হাসপাতালের বাহিরে মেলে না সে সেবা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, জেবিসি ও অন্বেষা নামের দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব সেবা নিশ্চিত করছেন তারা। তবে হুইল চেয়ারধারী ও স্ট্রেচার মালিকরা বলছেন রোগী বহনের সামগ্রী তাদের নিজস্ব কেনা। কোনো বেতন পান না হাসপাতাল কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে। অথচ হাসপাতালে হুইল চেয়ার ব্যবসার জন্য সকাল বিকাল ও রাতে ৩ ধাপে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করতে হয় তাদের। আর এ সুযোগ নাকি তাদের দিয়েছেন খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে জানান হুইল চেয়ারধারী নারী হ্যাপি বেগম।
রোগীর স্বজন সেজে জানতে চাইলে হ্যাপি বেগম জানান, তার মতো ৩০ জন হুইল চেয়ারধারী আছেন হাসপাতালে। তিন ধাপে ১০ জন করে হুইল চেয়ারের রোগী বহনের কাজ করেন তারা। বিনিময়ে ১৫০-২৫০ টাকা নেন। তবে ৫০০ টাকা দিলে কোন ঝামেলা ছাড়াই সিট ম্যানেজ করে দেবেন তিনি। আমাদের (রোগীর স্বজনদের) কোনো কাজই করতে হবে না। ৫০০ টাকার বিনিময়ে রোগী বেডে তোলা পর্যন্ত সব দায়িত্ব তার।
তবে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই ও ওষুধ সংকট অভিযোগ মিথ্যা জানিয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাফিউর রহমান বলেন, হাসপাতালের কোন স্টাফ, কর্মচারী হোক আর আউটসোর্সিং হোক রোগীর কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার সুযোগ নাই। এক সময় এমন পরিস্থিতি ছিল। আমরা অভিযান চালিয়ে সেটা বন্ধ করেছি। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সার্ভিস দিয়ে কেউ টাকা নেবে এটা আমরা কখনোই বরদাস্ত করব না। আমরা ইতিপূর্বে ব্যবস্থা নিয়েছি, আগামীতেও নেবো।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল সংকট আছে। এখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ আসে। প্রায় ১ হাজার টয়লেট আছে। সেগুলো পরিষ্কার করে রাখার মতো জনবল আমাদের নেই। জনবলে ব্যাপক ঘাটতি আছে।
ডাক্তার সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ব্যাপক ডাক্তার সংকট আছে। বিশেষ করে মিড লেভেলের ডাক্তার সংকট আছে। জুনিয়র ডাক্তারের সংকটের কারণ পদ সৃষ্টি না করেই ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে। ফলে সেবা দেওয়া ক্ষেত্রে সেখানে একটা গ্যাপ রয়ে গেছে। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সার্বক্ষণিক ভাবে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ আছে। সংকট নিরসনে কাজ করছি।