‘মাথার মধ্যে একে-৪৭ তাক করা ছিল, ট্রিগার চাপলেই মারা যেতাম’

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

‘মাথার মধ্যে একে-৪৭ তাক করা ছিল, ট্রিগার চাপলেই মারা যেতাম’

‘মাথার মধ্যে একে-৪৭ তাক করা ছিল, ট্রিগার চাপলেই মারা যেতাম’

‘যখন আমাদের মুক্তি দিবে, পাশে দিয়ে ইউরোপীয়ান জাহাজ ও উপর দিয়ে বিমান যাচ্ছিল, তখন আমাদের মাথায় একে-৪৭ তাক করা ছিল। তারা বলছিল, জাহাজ থেকে যদি কিছু করার চেষ্টা করে, সবাইকে একসাথে মেরে ফেলবে। তাদের হাত ট্রিগারে দেয়া ছিল, ভুলেও যদি গুলি বের হতো, সাথে সাথে মারা যেতাম। এটি একটি দুঃস্বপ্ন, ভুলে যেতে চাই।’

এভাবেই জলদস্যুর হাতে জিম্মি থাকাকালীন সময়ের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন জাহাজটির ইলেকট্রেশিয়ান পদে কর্মরত থাকা ফেনীর ইব্রাহিম খলিল উল্ল্যাহ বিপ্লব।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (১৪ মে) সোমালিয়ার জলদস্যুর কবল থেকে মুক্ত হওয়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ দেশে পৌঁছেছেন। জাহাজটিতে থাকা ২৩ নাবিকের মধ্যে ছিলেন ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ইব্রাহিম খলিল উল্ল্যাহ বিপ্লব। দীর্ঘ দুই মাস আটকে থাকার পর বিপ্লব ফেনীতে পরিবারের সদস্যদের কাছে এসেছেন। এসে জাহাজে জিম্মি থাকাকালীন সময়ের স্মৃতি তুলে ধরেন বিপ্লব।

বিপ্লব বলেন, দেশের মানুষের দোয়া, সরকারের সহযোগিতা ও আমার বাবা-মায়ের দোয়ায় আমি ফেরত এসেছি মৃত্যুর হাত থেকে৷ সরকার ও আমাদের কোম্পানি এস আর শিপিং এর কর্মকর্তারা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে সাপোর্ট দিয়ে জীবিত ফেরত এনেছেন। ফেরত আসার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ওই ২ মাস ছিল আমার জীবনের দুঃস্বপ্ন, সেটি শেষ হয়েছে এটিই জীবনের বড় পাওয়া।

বিজ্ঞাপন

জিম্মি থেকে মুক্ত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বিপ্লব বলেন, যখন আমাদের কোম্পানি মুক্তিপণ দিচ্ছিল, তখনকার একটি বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হয়েছে।
তারা ৬৫ জন ছিল, সবার হাতে একে-৪৭ অস্ত্র ছিল। তারা আমাদের মাথার মধ্যে অস্ত্র ধরে রেখেছিল, ট্রিগারে তাদের হাত ছিল। একপাশ থেকে ইউরোপীয়ান যুদ্ধ জাহাজ যাচ্ছিল, উপর দিয়ে বিমান যাচ্ছিল। তখন তারা আমাদের বলেছিল, ওই সময় যদি কোনো কিছু করার চেষ্টা করে তারা আমাদের সেখানেই মেরে ফেলবে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিল। আমার কাছে মনে হয়েছিল, জীবন ওখানেই শেষ। এত ভয় জীবনে আর কোনোদিন পাইনি। আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন।

জিম্মি হওয়ার প্রথমদিনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রথম যেদিন আমাদের আটক করে সেদিন সোমালিয়ার হাই রিস্ক জোন থেকে আমরা ৪৭০ নটিকেল মাইল দূরে ছিলাম। তারা একটি ইরানি ফিশিং জাহাজকে ১ মাস জিম্মি করে রেখেছিল। যখন আমাদের জিম্মি করছিল তখন আমি আমার ডিউটি রুমে যাচ্ছিলাম, তাৎক্ষণিক ইমারজেন্সি অ্যালার্ম বাজানো হয়েছে। ক্যাপ্টেন জানিয়েছে, জলদস্যু আমাদের জাহাজে আক্রমণ করছে। উপরে গিয়ে দেখি আমাদের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে।

বিপ্লব বলেন, তখন থেকেই মনের মধ্যে ভয় শুরু হয়েছিল। ক্যাপ্টেন অনেক চেষ্টা করেছিল, যাতে তাদেরকে উঠতে না দেয়া যায়, কিন্তু তারা সশস্ত্র ছিল, ফলে উঠে যেতে সক্ষম হয়। উঠে তারা গুলি করে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করে। তখন ক্যাপ্টেন আমাদের বলছিল, গোপন কক্ষে যাওয়ার জন্য। আমরা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ঠিক তখন আমাদের সেকেন্ড অফিসারের বুকে গুলি তাক করে, তখন সবাই তাদের সামনে বসে যাই। তারা আমাদের হাত উপর করতে বলে এবং জানায় তারা আমাদের জিম্মি করেছে।

তিনি বলেন, জিম্মি করার ২ দিন পর তাদের অন্য সদস্যরাও সশস্ত্র অবস্থায় জাহাজে আসে। সোমালিয়া কোস্টের পাশে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। আমাদেরকে যত রকমের ভয় দেখানো যায় তারা দেখিয়েছে। প্রতিদিন আমাদেরকে ব্রিজে রাখত, সপ্তাহে একদিন পানি দিত গোসল করার জন্য। আমাদের খাদ্য সংরক্ষিত ছিল সেগুলো আমরা খেয়েছি। তবে তারা অধিকাংশ নষ্ট করেছে। সম্পূর্ণ জাহাজকে তারা নষ্ট করে ফেলেছে। এটি জীবনের ভয়াবহ একটি স্মৃতি। ঘুমালে মনে হতো, মাথা উঠালেই একে-৪৭ গুলি আমার মাথায় তাক করা আছে। এভাবে দিন কেটেছে।

সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিপ্লব বলেন, দেশের মানুষ আমাদের চিনতো না, জানতো না। এরপরও তারা আমাদের জন্য দোয়া করেছে, দেশের মানুষের প্রতি আমৃত্যু কৃতজ্ঞতা। জলদস্যুরা আমাদের তখন বলতেছিল তোমাদের দেশের মিডিয়া অনেক ভালো, তোমাদের নিয়ে সর্বাত্মক খবর প্রচার করছে। তারা সবসময় বাংলাদেশের সকল নিউজ দেখছিল এবং আমাদের বলছিল। সাংবাদিকদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

উল্লেখ্য, মার্চ মাসের ১২ তারিখ কার্গো নিয়ে আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে দুপুরে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। পরে গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ৩টা ৮ মিনিটের দিকে এমভি আবদুল্লাহ থেকে দস্যুরা নেমে যায়। একই দিন বিকেলে দস্যুরা তাদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ বুঝে নেয়। একটি বিশেষ উড়োজাহাজে মুক্তিপণ বাবদ ৩ ব্যাগ ডলার এমভি আবদুল্লাহর পাশে সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়। স্পিড বোট দিয়ে দস্যুরা ব্যাগ ৩টি কুড়িয়ে নেয়। দস্যুমুক্ত হয়ে ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে সোমালিয়ার উপকূল থেকে আরব আমিরাতের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ। ২১ এপ্রিল এমভি আবদুল্লাহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়াহ পৌঁছে। সেখানে কার্গো খালাস করে জাহাজটি একই দেশের মিনা সাকার থেকে কার্গো লোড করে ১৪ মে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে ফেরত আসে।