পাহাড়ে কুমার শানু খ্যাত দৃষ্টিহীন শান্তি প্রিয় চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার জারুলছড়ি গ্রামে। শান্তির জন্মের পরপরই মারা যান তার মা। বাড়ির পাশে সন্তানহীন এক পরিবারে আশ্রয় হয় তার। তবে ভাগ্য বেশিদিন সহায় হয়নি। ১৯৮৬ সালে ডায়রিয়া ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হওয়ায় চিরতরে নিভে যায় চোখের আলো।
৩৮ বছর ধরে ভাগ্যে জোটেনি প্রতিবন্ধী ভাতার কোনো কার্ড। মাকে হারিয়ে যে পরিবারে আশ্রয় হয়েছিল সে পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পর একদম একা হয়ে পড়েন শান্তি। স্বজন-পরিবারহীন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষটি এ অবস্থায় নিজের কণ্ঠ, দুই হাত ও হাঁটুকে পুঁজি করে শুরু করেন অন্যরকম জীবন সংগ্রাম। ভিক্ষা না করে হাট বাজারে ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান গাওয়া শুরু করেন। পুরুষ কণ্ঠের পাশাপাশি নারী কণ্ঠেও হুবহু গান করেন তিনি। পছন্দ করেন বিখ্যাত কুমার শানুর গান। চেষ্টা করেন তার মতো কণ্ঠ দেয়ার। মজার ছলে নিজেকে পাহাড়ের কুমার শানু দাবি করেন।
সরেজমিনে তার সঙ্গে গল্প হয় খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারে। বিকেল বেলা জমজমাট এ বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে নিজের বাম পায়ের হাঁটুতে একধরনের শব্দ করে গান করছিল। দোকানে বসে একজন তার গান শুনে কয়েক টাকা দিলেন এবং আপ্যায়নও করালেন। এ ফাঁকে কথা হয় শান্তি প্রিয় চাকমার সঙ্গে।
দুঃখ ভরা জীবনে যেন কোন অভিযোগ বা চাওয়া নেই তার। ৩৮ বছর ধরে দৃষ্টিহীন হলেও সরকারি কোনো সুবিধার আওতায় আসেনি। ভবঘুরে হয়ে আজ এ হাট তো পরের দিন ওই হাট। এ ভাবে কেটে গেছে জীবনের ৫২টি বছর।
বাকি জীবনে কী আছে তা নিয়ে ভাবেন না জানিয়ে শান্তি বলেন, স্বনির্ভর বাজারের পাশে পুকুরপাড়ের ধর্মঘরে (বসার জায়গা) থাকেন। হাট বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে কয়েক টাকা পান তা দিয়ে খাওয়ার খরচ মেটান। জীবন নিয়ে আহামরি চিন্তা নেই তার। যখন যেখানে ইচ্ছা ঘুরে থাকতে চান। খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা ছাড়াও রাঙামাটির লংগদু, শুভলং ও কল্যাণপুরে ঘুরতে যান। পাহাড়ের কুমার শানু হয়ে গান শোনান ভক্ত শ্রোতাদের।
কণ্ঠে ভর করে জীবিকার সন্ধানে শান্তির বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে মুখ, দুই হাত ও বাম পায়ের হাঁটু। বছরের পর বছর ধরে হাঁটু পিটিয়ে পিটিয়ে গান করায় কালচে দাগ হয়ে গেছে। কোনো অনুভূতি নেই তাতে। সংসার করেননি জীবন সঙ্গীর ভরণপোষণ চালানোর সামর্থ্য নেই বলে।
গল্পের এক পর্যায়ে শান্তি বলেন, আমার গান শুনে অনেকে ভিডিও করে তা নাকি ইন্টারনেটে দেন। এ রকম ভিডিও দেখে আমাকে ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। তবে সেটি বেহাত হয়ে গেছে।
স্বনির্ভর এলাকার অমিউ চাকমা বলেন, তিনি প্রতিবন্ধী মানুষ। স্বজন ও পরিবারহীন এ মানুষকে ভাতা দেয়ার চেয়ে পুনর্বাসন অত্যন্ত জরুরি। সরকারি বেসরকারি যেকোন উদ্যোগে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানায়।