বাংলাদেশের মিডিয়ায় একটি শ্রেণি বৈষম্য ও মতাদর্শগত বৈষম্য রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। তিনি বলেন, ‘আমাদের মিডিয়ার একটা শ্রেণি বৈষম্য ও মতাদর্শগত বৈষম্য আছে। মুক্তিযুদ্ধ বলতে যে বয়ান আমাদের মিডিয়া বিশ্বাস করে, তা ধর্মগ্রন্থের মতো বানিয়ে ফেলেছে। সেই মুক্তিযুদ্ধ জনগণের প্রকৃতি মুক্তিযুদ্ধ কিনা, মুক্তিযুদ্ধের ভেতর যে গণযুদ্ধ ছিল, চাষা-ভূষা ও কৃষকের অংশগ্রহণ ছিল, আওয়ামীলীগের মধ্যে একাত্তরের একটি অংশ যে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, ভারত যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কবজা করে ফেলেছিল, এসব কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গল্পের মধ্যে আসে না।’
মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) বিকেল ৫টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব মিলনায়তনে “রাষ্ট্র রূপান্তপরের সময়ে সাংবাদিকতা” বিষয় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভাটির আয়োজন করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিএমইউজে)।
ফারুক ওয়াসিফ দাবি করেন, এই মুক্তিযুদ্ধ তো মানুষ ধারণ করেন না। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনো বেরিয়ে আসে নাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানের যে এলিট রুচি আছে, গণমাধ্যম সেটাকে আদর্শ মানদণ্ড ধরে তা আমাদের দেশের চাষা-ভূষা, উঠতি মধ্যবিত্ত, রক্ষণশীলরা ধারণ করে না। পত্রিকায় খবরে বা ছবিতে সকলের প্রতিনিধিত্ব নেই।
ফারুক ওয়াসিফ বলেন, যখন সাংবাদিকতার পতন হয়, তখন রাষ্ট্রেরও পতন হয়। ২০১৩-১৪ সালে শাহবাগ, শাপলায় যা হয়েছিল, আমরা তা বলতে পারিনি। যখন সংবিধান কাটাছেড়া করে তত্ত্বাবধায় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল, তখনই তো বোঝা গিয়েছিল এই দল আর কোনো দিন এই দেশে কোনো দিন নির্বাচন দেবে না, এক ব্যক্তির শাসন চলবে।
‘যে কোন বিরোধিকে রাজাকার, জঙ্গি বলা হতো, বিদেশিদের বন্ধ ভাবা হতো, দেশের মানুষকে শত্রু ভেবে অত্যাচার, নির্যাতন করা হতো। তখনই কী আমরা বুঝিনি কী সামনে আসছে? যখন বিডিআর হত্যা হলো, হেফাজতের কালো রাত (৫ মে), সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের বিষয়ে এখনও মিডিয়া লিখছে না। কারণ এই অভ্যত্থানের কোন মুখপাত্র নেই। ৪৭, ৫২, ৬৯, ৯০, এর অভ্যত্থানে মুখপাত্র ছিল আজাদ, ইত্তেফাক বা সংগ্রাম। কিন্তু এই অভ্যত্থানের মুখ্পাত্র নেই। আমরা কোনো সময় একটি গোষ্ঠী অর্থাৎ উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুখপাত্র দেখিনি। যাদের জঙ্গি, রাজাকার বা কিশোরগ্যাং বলা হতো, তারাইতো এসব তকমা ছিড়েছুড়ে অভ্যত্থানে অংশ নিয়েছিলেন। কোন পত্রিকা তাদের মুখপাত্র নয়। আবার বিডিআর গণহত্যা বা জুলাই হত্যাকাণ্ড বা আমাদের সীমানা আবার হাত ছাড়া হবে না, সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
পিআইবি মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ২০১৮ সালের পর তারা বড় বড় দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্নীতির কথা তারা বলেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচন যে রাতের আধারের নির্বাচন তা কিন্তু মিডিয়ারা বলে নাই। ২০১৪-১৫ সালে বিচারের নামে যে এক ধরনের প্রতিহিংসামূলক ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, সে কথা এখনো মিডিয়াগুলো বলছে না।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা খেপেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা তাকে স্বৈরাচার ও খুনী বলায়। কারণ এর আগে ছাত্রদল বা বিএনপি বলেছিল। এটি সহ্য করা হয়েছিল, দেশে গণতন্ত্র রয়েছে বোঝানোর জন্য। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা যে স্বৈরাচার ও খুনী বলেছে, এটি সহ্য করতে পারেনি। এ কারণে ওই রাতের পর শেখ হাসিনা গণহত্যা চালিয়েছিল। কারণ সে জানে এই স্বৈরাচার সবার মুখে প্রতিধিনিত হতে থাকবে।
সিএমইউজের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ নওয়াজের সভাপতিত্বে এতে আলোচক চিলেন নয়াদিল্লি বাংলাদেশের হাই কমিশনারের প্রেস মিনিস্টার ফয়সাল মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আর-রাজী ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমান।