ঘটনা পরিক্রমা: যেভাবে পদত্যাগ শেখ হাসিনার

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা

কথায় আছে ‘মুখের কথা আর বন্দুকের গুলি একবার বের হয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। দুটোই ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনে। শেখ হাসিনার নিজের দেওয়া এক বক্তব্যই কাল হলো। তার সে বক্তব্যের পরিণতি যে এমন হবে তা তিনি কখনোই ভাবেননি। তার এক বক্তব্যই কোটা বিরোধী আন্দোলনে গতি আনে। এ গতির মুখে দাঁড়াতে না পেরে ভেসে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল তার মসনদ।

২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে সরাসরি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারের উক্ত সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন।

বিজ্ঞাপন

সে রিটের শুনানি নিয়ে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এরপর মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে গত ৫ জুন রায় দেয়া হয়।

এ রায়ের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রপক্ষ’ আবেদন করলে ৪ জুলাই পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করে দেন চেম্বার জজ আদালত।

বিজ্ঞাপন

শুনানি সামনে রেখে পহেলা জুলাই থেকে কোটা বাতিলে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে’ এই আন্দোলন করে তারা।

৪ জুলাই সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রাখেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

আপিল বিভাগ ওই দিন শুনানি না করে ‘নট টুডে’ বলে আদেশ দেন। আদালত বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রপক্ষ যেন লিভ টু আপিল (নিয়মিত আপিল) করেন।

এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আন্দোলন হচ্ছে হোক। রাজপথে আন্দোলন করে কি হাইকোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন?

এরপর ৫ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন শুরু হয়। শুরুতে এই আন্দোলন অহিংস হলেও তা সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৫ জুলাই থেকে।

১০ জুলাই আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন। ৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করেন। আন্দোলনকারীরা আদালতের রায় প্রত্যাখান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ধীরে ধীরে আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে।

১৪ জুলাই সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’

কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে মর্মাহত ও অপমানিত বোধ করেন। এদিন রাত ১০টার পর প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ভেতরে জড়ো হয়ে স্লোগান আর বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তারা। পরে রাত ১১টার পর থেকে ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে।

তারা টিএসসি ও এর আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। শ্লোগানে শ্লোগানে উচ্চকিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে যোগ দেন মধ্যরাতের এ বিক্ষোভে। মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার,’ ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার,’ ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।

শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়েও অবস্থান নেন। তারা সেখানে ঘণ্টা দেড়েক অবস্থান করে রাত ১টার পর ফিরে যায়।

পরদিন সকালে ওবায়দুল কাদের এক বক্তব্যে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্বের জবাব দেবে ছাত্রলীগ।’ ওইদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন ১৬ জুলাই সারা দেশের শিক্ষাঙ্গণে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। সেদিন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে।

পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। আন্দোলন দমাতে প্রথমে ছাত্রলীগ ও দলীয় সমর্থকদের নামানো হয়। তাতে ফল না পেলে পরে পুলিশ, বিজিবি ও সর্বশেষ সেনাবাহিনীকে নামানো হয়।

১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা আদালতে ন্যায়বিচার পাবে। কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়।

১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দুপুরের পর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হতে থাকে। সেদিন ঢাকার বাড্ডা, যাত্রাবাড়ি ও উত্তরায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর ঘটে।

পরের তিন চার দিন ধরে টানা সংঘর্ষ চলে। সরকারি হিসেবে এ সব সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা ১৫০ জন হলেও অনেকে মনে করেন এ সংখ্যা ২৫০ এরও বেশি।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে ২৩ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করা হয়। প্রথম কয়দিন টানা কারফিউয়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে পরে তা শিথিল করা হয়। এর আগে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করা হয়। আটক করা হয় আন্দোলনের সমন্বয়কদের। কয়েকদিন আটক রাখার পর তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

৩ আগস্ট পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। ৪ আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম। শেষ রক্ষা হিসাবে আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা নাকচ করে দেন। ওইদিন ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিও ঘোষণা করেন তারা।

৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৪ পুলিশসহ শতাধিক নিহত হলে ওইদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। কিন্তু কারফিউ ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয় আন্দোলনকারীরা। ৬ তারিখ ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে সোমবার করার ঘোষণা দেয়। এতে সারা দেশ থেকে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়।

সোমবার (৫ আগস্ট) কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সরকার পতনের আন্দোলনের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।