যাত্রাবাড়ী থানা জুড়ে ধ্বংসস্তূপ আর ক্ষতের চিহ্ন

  • আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আগুনে পুড়ে যাওয়া যাত্রাবাড়ী থানা/ছবি: বার্তা২৪.কম

আগুনে পুড়ে যাওয়া যাত্রাবাড়ী থানা/ছবি: বার্তা২৪.কম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ছড়িয়ে পড়া সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ৫ আগস্ট রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ করে ছাত্র-জনতা। ওইদিন শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয় থানা ও পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ি ও চট্টগ্রাম মহাসড়ক এলাকায়।

এর ফলে ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতার আগুন ও হামলায় মৃত্যুকূপে পরিণত হয় যাত্রাবাড়ি থানা। এসময় থানার ভেতরে আটকে পড়া পুলিশ ও হ্যান্ডকাফ লাগানো আসামিকেও পুড়ে নির্মম মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। ঘটনার দুদিন পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় আট পুলিশ সদস্যের মরদেহ উদ্ধার করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পরিবারের সদস্যরা মরদেহ বুঝে নেন। যাত্রাবাড়ি থানাসহ সারাদেশে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় ৪৩ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। আর আহত হয়েছে হাজারের বেশি।

বিজ্ঞাপন
আগুনে পুড়েছে থানার সামনে রাখা বিভিন্ন গাড়ি

ঘটনার আটদিন পর মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে যাত্রাবাড়ি থানার অবস্থা অপরিবর্তিত দেখা গেছে। আইজিপি ময়নুল ইসলামের ঘোষণার পরে আজ (১৩ আগস্ট) মাত্র ১০ জন পুলিশ সদস্য থানায় যোগ দিয়েছেন। তবে এখনই তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। তারা নিরাপদে থানার ভেতরে অবস্থান করছেন।

যাত্রাবাড়ি থানার গিয়ে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও সেনা সদস্যরা আটক করেছেন। ওই ব্যক্তি থানার পুড়ে যাওয়া গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি করতে গিয়ে আটক হন। পরবর্তীতে তাকে থানার ভেতরে নিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

বিজ্ঞাপন
থানার সামনে পুড়ে যাওয়া গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি করতে গিয়ে আটক হন এ ব্যক্তি

থানার গেটে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী ও সেনা সদস্য। গেটে সাংবাদিক পরিচয়ে দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে সেনা সদস্যরা আটকে দেন। তারা জানান, থানার ভেতরে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের কাজ চলমান রয়েছে। তাই সাংবাদিক বা অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

গেটে দাঁড়িয়ে থানার ভেতরে যতদূর চোখ যায়, পুরোটাই ধ্বংসস্তূপ। থানার সামনের অংশে অন্তত অর্ধশত পোড়া গাড়ির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে রয়েছে। থানা ভবন জুড়ে জনতার ক্ষোভের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

আগুনে পুড়ে যাওয়া যাত্রাবাড়ী থানা/ছবি: বার্তা২৪.কম

থানার সামনে বহু সেবাপ্রত্যাশী এলেও কাউকেই থানায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ, থানা পুলিশের কিছু সদস্য আসলেও তারা সেবা দেওয়া শুরু করেননি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) খাতা কলমের হিসাবে ঢাকার ৫০টি থানার কার্যক্রম চালু হয়েছে। সেই হিসেবের সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া গেলো না।

কয়েকজন সেবা প্রত্যাশীর সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কম’র। তাদের একজন যাত্রাবাড়ি এলাকার সুফিয়া প্লাজায় এমএক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক মো. ইমরান। গত ১৭ জুলাই প্রতিষ্ঠানের মালামাল তোলার কাজ করার সময়ে হঠাৎ চোখে গুলিবিদ্ধ হন। প্রতিষ্ঠানের কাজ করতে গিয়ে আহত হলেও তার পাশে দাঁড়ায়নি এমএক্স নামের প্রতিষ্ঠানটি। নিজ খরচে চিকিৎসা নিয়ে আবারও কাজে যোগ দেন ইমরা। তবে চিকিৎসক তাকে ভারী কাজ করতে নিষেধ করলেও প্রতিষ্ঠানটি তাকে এখনও ভারী কাজ করতে বাধ্য করছে। আর কাজ না করলে চাকরি ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে। তাই প্রতিকার পেতে থানায় এসেছেন। কিন্তু থানায় চোখে গুলি আহত ইমরানের কথা শোনার কেউ নেই।

থানার সামনে ছেলের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কমদতী থানার রায়েরবাগের মোহাম্মদবাগ এলাকার বাসিন্দা রাশেদা বেগম।

তিনি বলেন, তার বড় ছেলে সোহেল রানা গত ১৮ জুলাই রাতে যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়। পেশায় গার্মেন্টসের জুট ব্যবসায়ী সোহেলের সন্ধানে বিভিন্ন হাসপাতাল ও মর্গে খুঁজেও আমার ছেলের কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। ছেলের সন্ধান চেয়ে একটি কমপিউটারে টাইপ করা জিডির কপিও নিয়ে এসেছেন মা রাশেদা। কিন্তু তার জিডি গ্রহণ করার মতো কেউই নেই। যদিও গতকাল অনেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলো নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা। তবে আজ থানায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য যোগ দেওয়ায় তারা সেটিও করছেন না।

গত ৫ জুলাই থেকে পুড়ে যাওয়া থানার নিরাপত্তায় কাজ করছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে একজন ল্যাবটরি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন ভূইয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, সরকার পতনের খবর পাওয়ার পরেই কিছু মানুষ থানায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাশাপাশি অনেকেই থানার ভেতরে লুটপাট চালায়। এমনকি একদল লোক ট্রাক ভরে থানার অস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছে। যদিও আমরা ভাঙারি দোকানসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু গ্রেনেড ও অস্ত্র উদ্ধার করেছি। তবে বেশিরভাগ অস্ত্র এখনো বেহাত হয়ে আছে।

গত ৭ দিনে থানার নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি আমরা শিক্ষার্থীরা চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছি। প্রায় ৮ লাখ টাকার মালামাল ও বিপুর পরিমাণ টাকা উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও যাত্রাবাড়ি এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক, দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার কার হয়। থানায় চুরির চেষ্টা ও মাদকসহ অন্তত দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার শেষে সব কিছু সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। আজকে থানা পুলিশের বাকী সদস্যরা আসলে আমরা তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে দায়িত্ব শেষ করবো।

এ দিকে পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা কাজ করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন লেফটেন্যান্ট মুগ্ধ। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ি থানায় ১০ জন পুলিশ সদস্য যোগ দিয়েছে। আমরা তাদের নিরাপত্তায় আছি। থানার ভেতরে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হচ্ছে। তাই ভেতরে সকলের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। বাকি পুলিশ সদস্যদের আমরা স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় আছি।