পিয়ন থেকে হিসাবরক্ষক, নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটিপতি মোজাম্মেল

  • জাহিদ রাকিব ও কানজুল কারাম কৌশিক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইনসেটের ছবি: মোজাম্মেল হক

ইনসেটের ছবি: মোজাম্মেল হক

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্যের অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে হয়েছেন একই অফিসের হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকরির বর্তমান পদবী উপাচার্যের বাসভবনের সুপারভাইজার। সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর মোর্শেদ ও শাহজাহান হাওলাদারের সহযোগিতায় সুপারভাইজার হয়ে হিসাবরক্ষক কর্মকর্তার পদ বাগিয়ে নেন। এই দু'কর্মকর্তার যোগসাজশে নিয়োগ বাণিজ্য করে মোজাম্মেল বনে গেছেন কোটিপতি। বাসার বাজারের বিল কায়দা করে অফিসের কেনাকাটার ভিতরে দেওয়াসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অফিসে বিগত আওয়ামী সরকারের পরিচয় ব্যবহার করে ছাত্রশিক্ষক কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত খারাপ ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপাচার্যের অফিসের এক কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমের কাছে অভিযোগ করে বলেন, মোজাম্মেল হক আওয়ামী লীগের এক নেতার পরিচয় ব্যবহার করে জাল সার্টিফিকেট ব্যবহার করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে হয়েছেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, মোজাম্মেল হকের পদায়নের পর তাকে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সুপারভাইজার করা হয়। কিন্তু সরকারের প্রভাব খাটিয়ে তিনি হয়ে যান উপাচার্য অফিসের হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা। হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা হয়ে তিনি বাসার বাজারের বিল অফিসের বিলের সাথে জমা দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন। অফিস ও ভবনের যত ধরনের কেনাকাটা বা কাজ হতো তার ১০% দিতে হতো তাকে।

ওই কর্মকর্তার দাবি মোজাম্মেল হক আর্থিক কেলেঙ্কারি করে থেমে থাকেননি। সাবেক ডেপুটি রেজিস্টার জাহাঙ্গীর মোর্শেদ ও শাহজাহান হাওলাদারের সহযোগিতায় নিয়োগ বাণিজ্যতে জড়ান তিনি। নিয়োগ বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সেইসাথে করতেন বদলি বাণিজ্য।

বিজ্ঞাপন

যেভাবে উত্থান

জানা যায়, মোজাম্মেল হক সাবেক অধ্যাপক ড. সুলতানা সফির বাসায় কাজ করতেন। তারপর এই অধ্যাপক ১৯৯৭ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পিয়ন পদে চাকরি দেন। সেখানে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠলে শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সুলতানা সফি তাকে বদলি করে শামসুন নাহার হলে নিয়ে আসেন। এসময় মোজাম্মেল হক নারী কেলেঙ্কারির সাথেও জড়িয়ে পড়েন।

এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে কিছুদিন পর অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে বিশেষ সুপারিশের মাধ্যমে তাকে ওখান থেকেও বদলি করে দেওয়া হয় মেডিকেলের ডিন অফিসে। ডিন অফিসে পুনরায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠলে তাকে বদলি করা হয় রেজিস্টার অফিসের ডেসপাচ শাখায়। ডেসপাচ শাখা থেকে ২০০৮ সালে ভিসি অফিসের টি-ম্যাকার (চা তৈরির কাজ) কাম পিয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানে আসার পরই ক্ষমতার দাপট দেখানো শুরু তার।

চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে যেভাবে তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালে উপাচার্যের দায়িত্ব নিলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী হওয়ার চেষ্টা করেন মোজাম্মেল। তৎকালীন উপাচার্য তার সার্টিফিকেট দেখে তা কিনতে পাওয়া যায় উল্লেখ করে পদোন্নতি দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে শাহজাহান হাওলাদার ও শাহজাহান মিয়ার জোর সুপারিশে ২০১৭ সালে উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান তাকে তৃতীয় শ্রেণিতে পদোন্নতি দেন। এর কিছুদিন পরেই তাকে ভিসি ভবনের সিনিয়র সুপারভাইজার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তৎকালীন রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকারের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মোজাম্মেল হক। কথিত আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যের একটা অংশের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। পদ বাণিজ্য আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ঢাকায় তার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে তার এফডিআর ও ডিপিএস চলমান থাকার কথাও জানা যায়।

উপাচার্যের বাসভবনে মালামাল লুটের অভিযোগ

২০২৩ সালে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান মেয়াদ শেষ হলে ভবনে হামলা ও ভাঙচুরের পর ঐতিহাসিক জিনিসপত্র ও মালামাল সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে। সেসময় বাসার মূল্যবান মালামালের সাথে সব ধরনের ফার্নিচার ট্রাকে করে দেশের বাড়িতে নিয়ে যান মোজাম্মেল হক। একই কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি সদ্য বিদায়ী উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের সময়ও।

মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে ওঠা জাল সার্টিফিকেট দিয়ে ভুয়া পদোন্নতির অভিযোগের বিষয়ে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, এটা সত্য নয়। এটা জাল সার্টিফিকেট কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ঢাবি উপাচার্যের সুপারভাইজার থেকে উপাচার্য অফিসের হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা হওয়া বিষয়ে তার দাবি, ওই পদে কেউ না থাকায় তাকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেইসাথে নিয়োগ বাণিজ্যর সাথে তিনি জড়িত নয় বলে দাবি করেন তিনি। তার দাবি একটি শ্রেণি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এসময় নিউজ না করার জন্য প্রতিবেদককে অনুরোধ জানিয়ে দেওয়া হয় চায়ের দাওয়াত।

মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার (ভারপ্রাপ্ত) মুন্সী শামস উদ্দিন আহম্মদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি রেজিস্টার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র এক সপ্তাহ হলো। এর আগেও মোজাম্মেল ছিল সেটা জানি। উনি উপাচার্য মহোদয়ের অফিসের কাজ করে, হিসাবরক্ষকের কাজ করে, উপাচার্যের বাংলোর ও দেখভাল করেন সেগুলো জানতাম। তবে তার ব্যাপারে এ অভিযোগগুলোর ব্যাপারে জানতাম না।

মোজাম্মেলের বেশ কিছু কেনাকাটার ডকুমেন্ট প্রতিবেদকের হাতে এসেছে, জানতে পেরে তিনি বলেন, এ ধরনের ডকুমেন্ট থেকে থাকলে সে অফিসের কারো সাথে কথা বললে বিস্তারিত জানতে পারা যাবে। এছাড়াও কেউ যদি দাপ্তরিক উপায়ে কোন অভিযোগ করেন, উপাচার্য মহোদয় আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, এসব ব্যাপারে আমার অবস্থান পরিষ্কার। আমি আইনগতভাবে যেগুলো প্রয়োজন সেগুলো দেখবো। তবে প্রত্যেককে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দিয়ে আইনগতভাবে যেটা করার সেটাই করবো।

যথাযথ উপায়ে অভিযোগ দেওয়া হলে এ ব্যাপারে তদন্ত করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা অবশ্যই করা হবে। আমার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে তবুও করা হবে। সবার ক্ষেত্রেই সেটা হবে।

"আমার এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখার আগ্রহ আছে। তবে এই মুহূর্তে আমাদের 'ইমিডিয়েট ক্রাইসিস' (একাডেমিক কার্যক্রম চালু) মোকাবেলা করতে হচ্ছে"।

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্টার প্রবীর কুমার সরকারের হাত রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে তদন্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার এ বিষয়ে আরও জানতে হবে, বুঝতে হবে। আর আমার জেনারেল প্রিন্সিপাল হলো, ব্যক্তিকে আমি চিনব না, যদি কেউ পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়, সে ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।