‘হাসপাতালের সামনে পড়েছিল শিহাবের লাশ, কাপড় উল্টিয়ে আঁতকে ওঠেন ছোট ভাই’

  • মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ওয়াকিল আহমেদ শিহাব

ওয়াকিল আহমেদ শিহাব

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পড়ে ছিল শিহাবের নিথর দেহ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জরুরি বিভাগের সামনের লাশ দেখেছিলেন নিহতের ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম। একে একে সব লাশের মুখ দেখছিলেন তিনি, প্রথমটা উল্টিয়ে দ্বিতীয়টি উল্টানোর সাথে সাথে ভাইয়ের লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বার্তা২৪.কমের প্রতিবেদকের কাছে সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি তুলে ধরেন সায়েম।

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামের আফছার ভুঞা বাড়ির সৌদি প্রবাসী মো. সিরাজুল ইসলামের ছেলে ওয়াকিল আহমেদ শিহাব (২০)। গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত হন তিনি। পিঠে, মাথায় ও পায়ে গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয় শিহাবের শরীর। মহিপাল সার্কিট হাউজ রোড থেকে উদ্ধার করে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় সহযোদ্ধারা।

বিজ্ঞাপন

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সায়েম বলেন, সেদিন দুপুর ১২টার দিকে বাড়িতে এসে আম্মুর সাথে দেখা করে। আম্মু তাকে চুল কাটাতে টাকা দিয়ে সেলুনে যেতে বলে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আম্মুর সাথে কথা বলে বিদায় নেয় ভাইয়া। সেটিই ছিল আম্মুর সাথে শেষ দেখা। আম্মুর সাথে কথা বলে এক বন্ধুর সাথে রাস্তার দিকে যায়। দুজনে নাস্তা করে ভাইয়া সেলুনে যায়। এরপর ভাইয়ার কাছে এক বন্ধু ফোনকল করে জানতে চায় আন্দোলনে যাবে কিনা, তখন ভাইয়া সেলুনে চুল কাটতে বসেছিল। বন্ধুর ফোন পেয়ে সেলুন থেকে বের হয়ে মহিপাল আন্দোলনে চলে যায়।

তিনি বলেন, সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে শামিল হয়। যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন ভাইয়ার বন্ধু ফ্লাইওভারের উপরে চলে যায় আর ভাইয়া সার্কিট হাউজ রোডে ঢুকলে তার উপর এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। এতে ভাইয়ার মাথায় পিঠে এবং পায়ে ৩টি গুলি লাগে।

বিজ্ঞাপন

কান্নাজড়িত কণ্ঠে সায়েম বলেন, সেদিন ঘটনার পর আমি ভাত খাচ্ছিলাম তখন আম্মু বলল শিহাব এত দেরি কেন করছে তার খোঁজ নে। ভাইয়াকে অনেকবার কল দিলেও রিসিভ করেনি। ভাইয়া যেখানে কাজ করে সেখানেও খোঁজ নিই, তবে তারা জানলেও আমাদের তখন কিছু বলেনি। বিকালে সবাই এসব বিষয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন একজন কল ধরে বলে তিনি সদরে আছেন। আমরা ভেবেছি ভাইয়া কাউকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে, তাই দেরি হচ্ছে। তখনি আমার এক ভাইয়া কল করে বলে শিহাব গুলিবিদ্ধ। তখন সবাই কান্না করতে থাকে।

হাসপাতালে গিয়ে এদিক সেদিক লাশ খুঁজছিলাম উল্লেখ করে সায়েম বলেন, আমি এবং আমার চাচ্চু মিলে হাসপাতালে যাই। পথে কোন গাড়ি ছিল না, অনেক ভোগান্তি হয়েছে যেতে। সর্বশেষ একটি অটো করে হাসপাতালে যাই। ভাইয়াকে যখন খুঁজছিলাম তখন জরুরি বিভাগের সামনে ৫-৬টা লাশ পড়েছিল। একটি উল্টিয়ে দেখি ভাইয়া না, পরেরটা উল্টানোর সাথে সাথেই ভাইয়ার লাশ পেয়ে যাই। এসব বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সায়েম।

তিনি বলেন, লাশ পাওয়ার পর সবাই বলাবলি করছিল দেরি করলে লাশ গুম করে ফেলবে। তড়িঘড়ি করে একটা সিএনজি করে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি। সেদিন আম্মু অজ্ঞান ছিল সারাদিন। নিজেকে দোষ দিচ্ছিল কেন চুল কাটাতে বলছি। কিন্তু ভাইয়া চুল না কেটে আন্দোলনে গিয়ে শহিদ হয়ে যায়।


ভাইয়ের ভালো কাজের কথা উল্লেখ করে সায়েম বলেন, তিনি সবসময়ই মানুষের উপকারে কাজ করত। রক্তদান কর্মসূচি সামাজিক কার্যক্রম ও খেলাধুলার সাথে লেগে থাকত সবসময়। ইচ্ছা ছিল পরবর্তীতে বিদেশ চলে যাবে, তার আগে মহিপাল প্লাজায় মোবাইল দোকানে হাতের কাজ শিখছিল।

এদিকে ছেলের জন্য এখনও আহাজারি করছেন শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার। ছেলেকে চুল কাটাতে কেন দিলাম এসব বলে বলে আহাজারি করছেন তিনি। তিনি বলেন, ছেলে সবসময় আমার কাছে থাকত সেদিনও আমার সাথে দেখা করে গেছে কিন্তু কে জানত সেটিই ছিল শেষ দেখা। দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়েছিল সে তবে খুনিরা তাকে মেরে ফেলল। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।

শিহাব হত্যার বিচার চেয়েছেন তার এলাকাবাসী। দক্ষিণ কাশিমপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, ছেলেটা সবসময় ভালো কাজের সাথে যুক্ত থাকত। কারও প্রয়োজনে সবার আগে দৌড়ে যেত। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে গুলি করে তাকে হত্যা করেছে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

এ ঘটনায় ২০ আগস্ট রাতে শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বাদী হয়ে ১৫১ জনের নামোল্লেখ ও আরও ১০০-১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ফেনী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ও ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে আসামি করা হয়েছে।

ভাইয়ের হত্যার বিচার দাবি করে সায়েম বলেন, ভাইকে তারা নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। এটার মত নির্মমতা আর নেই। আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। যারা গুলি করেছে সবাইকে যাতে বিচার করা হয় সে দাবি জানান তিনি।

ওয়াকিল আহমেদ শিহাব ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামের আফছার ভুঞা বাড়ির সৌদি প্রবাসী মো. সিরাজুল ইসলামের ছেলে। তিনি ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ২০২১ সালে জায়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন শিহাব। পরবর্তীতে মহিপাল প্লাজায় মোবাইল মেকানিকের কাজ শিখছিলেন তিনি। পরিবারে ২ সন্তানের মধ্যে বড় শিহাব। তার ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম তামিরুল উম্মাহ মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন।