পদ্মা নদীর সুরক্ষা ও দেশজুড়ে নৌ পথ চালুর দাবি
দেশের নদ-নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পদ্মা নদীসহ সকল নদ-নদীর যথাযথ সংরক্ষণ এবং ‘ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং’ এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নৌপথ চালুর দাবিসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছেন তরুণরা।
রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) দুুপুরে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়ন গবেষণাধর্মী স্বেচ্ছাসেবী ও যুব সংগঠন ‘ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ (ইয়্যাস)।
সংগঠনটির ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত শেষে যুব সংগঠন ‘ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র সভাপতি মো. শামীউল আলীম শাওন ও সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক যৌথ স্বাক্ষরিত ১০ দফা দাবি সম্বলিত স্বারকলিপি তার হাতে তুলে দেন।
স্মারকলিপির অনুলিপি রাজশাহীর জেলা প্রশাসককেও প্রদান করেন তারা। একই দাবি সম্বলিত পৃথক স্বারকলিপি জিইপি রেজিস্ট্রি ডাক যোগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার সদয় অবগতির জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রেরণ করা হয়েছে।
স্মারকলিপিতে জানানো হয়েছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা মোকাবিলা করতে নদ-নদী, পুকুর-ডোবা, জলাশয়-জলাধার-জলাভূমি দখল-দূষণ ও ভরাট বন্ধ এবং খনন ও পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। নদী উন্নয়নে রয়েছে সব উন্নয়নের মূলে। বিশেষ করে টেকসই ও অভিঘাত সহনশীল বৈচিত্র্যপূর্ণ, বৈষম্যহীন নগর ও পরিবেশ উন্নয়নের চাবি কাঠি। সে জন্য নদ-নদী ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণই সার্বিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বরেন্দ্র অঞ্চলের নদীগুলোকে হত্যা করা হয়েছে যখন পদ্মাকে তার পানির ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী বাঁচলে বাঁচবে এই জনপদ। বাঁচবে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সহ সুরক্ষা হবে এই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান। রাজশাহী শহরের বিভিন্ন দূষিত কঠিন, তরল, বিষাক্ত প্লাস্টিক ও মেডিকেল বর্জ্য পদ্মা, শিব-বারনই নদীসহ আশেপাশের জলাধারগুলোতে পড়ার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্র। নষ্ট হচ্ছে কৃষি জমি। অন্যদিকে নদ-নদী, পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলাশয়-জলাধার গুলোয় পানি না থাকার কারনে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষসহ আদিবাসীরা পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
নদ-নদী, জলাধারগুলোসহ পানির উৎসগুলো নষ্ট করে এখন পানি বিক্রির প্রকল্প তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। পানির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজগুলোতে দিনে দিনে সহিংসতা ও অপ্রীতিকর ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জীবন জীবিকা সংকটে পড়েছে।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, পদ্মানদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা জনপ্রিয় একটি স্থান ‘সীমলা পার্ক’। যা পূর্বে ঐতিহাসিক বাবলা বন হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই স্থানে প্রচুর পাখির বসবাস। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ‘ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র কর্র্তৃক ‘বন্যপ্রাণী ও পাখির প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও অঙ্গীকার’ শীর্ষক প্রচারাভিযান পরিচালনা করা হয়।
প্রচারাভিযানকালে সকল পাখি ও প্রাণীর সুরক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সেখানে ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২’ সম্বলিত সচেতনামূলক প্রচারণা বোর্ড স্থাপন করা হয়। স্থানটিকে পাখি ও প্রাণীদের অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে চেষ্টা করা হয়। এমন একটি প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ স্থানটি আজ দখল হয়ে গেছে। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে কংক্রিটের অবকাঠামো। সেখানে থাকা সবুজ বৃক্ষ যেখানে পাখিদের বাসস্থান ছিল সেগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। পুরো এলাকাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নদী দূষণের বিষয়টি তুলে ধরে স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, যথাযথ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ময়লা-আবর্জনা, দূষিত পানি এমনকি মেডিকেল বর্জ্য সরাসরি পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে। যার ফলে ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ ‘বিপদজনক বর্জ্য ও জাহাজ ভাঙ্গার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১১’, ‘চিকিৎসা-বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮’ সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
দাবিগুলো হলো:
১. জীবন্ত সত্তা পদ্মা নদী ও নদী পাড় দখল ও সিন্ডিকেট মুক্ত করার লক্ষে ‘সীমলা পার্ক’ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্তৃক গড়ে তোলা সকল অস্থায়ী ও স্থায়ী অবকাঠামো সহ সমগ্র পদ্মাপাড় জুড়ে নির্মিত অবকাঠামোগুলো অবিলম্বে উচ্ছেদ করে দখলমুক্ত ও জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
২. জীবন্ত সত্তা পদ্মা নদী ও নদী পাড় সকল ধরণের প্লাস্টিক, পলিথিন সহ সকল প্রকার দূষনমুক্ত করতে হবে। পদ্মা পাড়ে থাকা চলাচলের সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা হটিয়ে জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে সৌন্দর্য্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় পদ্মাপাড়ে গরু-ছাগল সহ সকল প্রকার গবাদি পশু পালন বন্ধ করতে হবে।
৩. সমগ্র পদ্মা পাড়জুড়ে সবুজ বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পদ্মা পাড়জুড়ে ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে পদ্মা পাড়জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। একই সাথে তথ্য কেন্দ্র স্থাপন ও ট্যুর গাইডের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৫. পদ্মার সাথে সংযোগ হওয়া শাখা এবং উপশাখা নদ-নদী, পুকুর-ডোবা, জলাশয়-জলাধার-জলাভূমি, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় সহ সকল জলাধারগুলোর জীবন ফিরিয়ে আনতে হবে, পুনরায় খনন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
৬. যথাযথ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতির রসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতিতে সৃষ্ট জলবায়ু ধ্বংস নিশ্চিত না করে কোন কিছু পদ্মা নদীতে ফেলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
৭. জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত ‘আর্ন্তজাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশনে’ দ্রুত বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষর করতে হবে এবং ভাটির দেশ হিসেবে এই আইনের সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩’ এর সংশোধিত খসড়া ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০২০’ দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩’ এর যুগোপযোগী সংস্কার ও প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৯. নদীমাতৃক বাংলাদেশের সকল (শাখা ও উপ নদ-নদীসহ) মৃত এবং মৃতপ্রায় নদীগুলোকে বাঁচাতে সার্বিক ভূমিরূপ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদী এবং এগুলোর শাখা-প্রশাখা যে সমস্ত নদীতে পানি প্রবাহের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে তাঁর সার্বিক মূল্যায়ণ করে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের সকল (শাখা ও উপ নদ-নদীসহ) নদ-নদীগুলোকে দখল-দূষণমুক্ত করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদ-নদীগুলোর গতিপথ অপরিবর্তিত রেখে যথাযথভাবে ‘ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং’ করে দেশের অভ্যান্তরীন ও আন্তর্জাতিক ‘নৌ পথ’ চালু করতে হবে।
১০. নদী দখল-দুষণ-ভরাট ও সিন্ডিকেট মুক্ত করতে পৃথক মনিটরিং সেল গঠন ও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে অভিযান পরিচালনায় ও পরবর্তী সময়ে আবারও দখল ও দূষণ রোধ করতে এলাকাবাসী, স্থানীয় তরুণ প্রজন্ম, সামাজিক, যুব ও তরুণ সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে।