আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্যে ভোগান্তিতে গ্রাহক
হাঁটতে গেলেই লাগে গায়ে-গায়ে ধাক্কা। দাঁড়ালেও নেই স্বস্তি। ‘নতুন না পুরান’ এমন প্রশ্নে স্বস্তি নেই চায়ের দোকানেও। কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়েও জো নেই একটু একলা থাকার। ছুড়ে আসে প্রশ্ন, ‘ভাই লাগলে বলেন, পাসপোর্ট পাবেন সবার আগে’!
বলছিলাম আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্টের অফিসের কথা। দালালদের দৌরাত্ম্য এতটাই যে, পাসপোর্ট সংগ্রহের এক লাইন ছাড়া বাকিটা যেন ‘দালাল রাস্তা’। সাহায্যের নামে এগিয়ে আসছেন, বাকপটুতায় হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) পাসপোর্ট অফিসটিতে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান করে এমন চিত্রেরই দেখা মেলে। এসময় পাসপোর্ট অফিসের সামনের রাস্তা, চা-দোকান, ফটোকপির দোকান, পাসপোর্ট অফিসের মূল ফটকসহ পাসপোর্ট ফাইল জমা দেয়ার জন্য নির্ধারিত নিচতলায়ও চোখে পড়ে দালালদের অবাধ যাতায়াত।
দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করতে গেলেই কোন না কোন দালালের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের। দালাল এসে জিজ্ঞেস করছে, সাহায্য লাগবে কিনা, নতুন পাসপোর্ট না পুরাতন পাসপোর্ট, ডকুমেন্টস ঠিকঠাক আছে কিনা, দ্রুত লাগলে করে দেয়া যাবে, এর মতো নানা প্রশ্ন। অনেকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে করছে প্রতারণাও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে আসা সেবাপ্রার্থীদের ফরম পূরণ, ফরম সত্যায়ন, ব্যাংকে ফি জমা, কাগজপত্র ঘাটতি, ভুল বা ভুয়া কাগজপত্র করে দেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। সব সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে হয়রানি করে পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের।
অতিরিক্ত ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার বিনিময়ে কোন রকম পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রস্তাবও দেয় প্রার্থীদের। এভাবে নানা লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে হাতিয়ে নেয় টাকা। প্রলুব্ধ হয়ে হয়রানিতে পড়ে পাসপোর্টপ্রত্যাশীরা।
এমনই একজন দুলাল মিয়া (ছদ্মনাম)। প্রায় সাত বছর ধরে বিবাহিত, তবে পাসপোর্টে পরিবর্তন হয়নি সে স্ট্যাটাস। এবার রিনিউ আবেদনে বৈবাহিক অবস্থা অবিবাহিত হতে পরিবর্তন করে বিবাহিত করার আবেদন করেছেন। কিন্তু নিকাহনামা নিয়ে না আসায় পড়েন ঝামেলায়। তার ফাইল জমা নেননি পাসপোর্ট কর্মকর্তা।
দুলাল মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এক দালাল পাঁচশো টাকা নিয়ে ম্যারিড সার্টিফিকেট দিছে, কিন্তু ভিতরে জমা নিচ্ছে না। বলতেছে নিকাহনামা লাগবে। এখন ঐ দালালকে খুঁজতেছি, পাঁচশো টাকা ফেরত নিতে হইবো’।
পাসপোর্ট রিনিউ করতে এসে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কথা বলায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক সেবাগ্রহীতা। তিনি বলেন, ‘আইডি কার্ডের সঙ্গে আমার পাসপোর্টের চৌধুরী বানান কারেকশন করছি। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ আছে এই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এইটাও বলে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবো’।
ঠিক না হলে সমন্বয়ক লাগায় দেয়ার হুমকি দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘মেয়াদ থাকতে থাকতে বানালাম যেন পুলিশ ভেরিফিকেশন না লাগে। আমি এখন পর্যন্ত ইউরোপের ১৪টা দেশ ঘুরছি। এইজন্য আজকে আসছি, তারপর সমন্বয়ক লাগায় দিবোনে’।
ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে আসা এমন আরও কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বললে, তারাও এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। তাদের অনেকেরই অভিযোগ, নতুন সরকার আসছে কিন্তু কোন কিছুই তো ঠিক হচ্ছে না। এখনো আগের মত প্রকাশ্যেই দালাল ঘোরাফেরা করছে, দেখার কেউ নেই। আনসার সদস্য নিজেরাই তো আড্ডা দিচ্ছে দালালদের সঙ্গে, সেখানে আর কী ঠিক হবে!
নাম পরিচয় গোপন রেখে কথা হয় এক দালালের সঙ্গে। পাসপোর্ট সংশোধন করতে দিলে, কয়েক বছর যাবত আটকে আছে, এখন কী করা যায় এমন প্রশ্নে প্রস্তাব দেন এক হাজার টাকা দেয়ার। সে টাকা দিলে সে জানিয়ে দিবে এখন কী অবস্থায় আছে পাসপোর্ট, আর পাসপোর্ট বের করতেই বা কত টাকা লাগবে। তবে অগ্রিম টাকা দিতে না চাইলে সটকে পড়ে সে দালাল।
পরে একই বিষয়ে কথা হয় আরিফ নামের আরেক দালালের সঙ্গে। কাজটি আজকেই করাবো কিনা এমন প্রশ্নে আগামীকাল করার কথা জানালে, কাজটি করে দেয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করেন এই দালাল। তবে টাকা লাগবে ১০ হাজার, সময় লাগবে এক সপ্তাহ বলে সাফ জানিয়ে দেন আরিফ। তার কথা, আজ (মঙ্গলবার) যদি সব কাগজপত্র দিয়ে যান তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে সব কাজ হয়ে যাবে। আগামী মঙ্গল বা বুধবার এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন।
টাকা কখন দিতে হবে জানতে চাইলে আরিফ বলেন, যখন কাগজ জমা দিবেন, টাকা তখনই দিতে হবে। পাসপোর্ট হাতে পাবার পর টাকা দিতে চাইলে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ১/২ হাজার টাকা এখন কম দিতে পারবেন। বাকি টাকা আজই দিতে হবে। না হলে কাজ হবে না। পরে আগামীকাল করতে চাই জানালে যোগাযোগের জন্য নিজের নাম্বার দিয়ে চলে যান।
এনিয়ে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপ-পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দালালের কাছে যান কেন? দালাল একেকজনের কাছ থেকে ১০/২০/৪০/৫০ হাজার টাকা নিচ্ছে। আমি যদি ১২০০ লোকের মধ্যে ৩০০ লোক ফেরত দিতাম, ৩০টা লোক ফেরত দিতাম … আমি তো কাউকে ফেরত দিচ্ছি না। ফলে আপনি কেন দালাল ধরে আসবেন’।
দালালরা এসে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘যাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো সে কি পঙ্গু? তাকে তো অন্যের সামনে দাঁড় করায়নি, পিছনেই দাঁড় করাচ্ছে তাহলে সে কি পঙ্গু যে সে তার (দালাল) হাত ধরে এসে দাঁড়াতে হবে? যে দালালের মাধ্যমে আসছে তাকে জিজ্ঞেস করেন সে কেন দালালের মাধ্যমে আসছে’।
পরে দালালদের সঙ্গে দায়িত্ব পালনরত আনসার সদস্যরাও জড়িত জানালে তিনি আনসার এপিসিকে ডেকে এনে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। এসময় আনসার এপিসি ফেরদৌস আহমেদ ছবি দেখে দুই আনসার সদস্যকে সনাক্ত করেন। তার মধ্যে একজন ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য হওয়ায় সেটা ব্যাটালিয়ন আনসারকে জানানোর কথা বলেন। আফজাল হোসেন নামের অন্য আনসার সদস্যকে তাৎক্ষণিক মূল ফটক থেকে সরিয়ে অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত করা ও তাকে তিরস্কার করা হবে বলেও জানান ফেরদৌস।