কাশোরারচরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ভাসমান সবজির চাষ

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম, কিশোরগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সবকিছুর সাথে কৃষিতেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। পুরাতন পদ্ধতি ছেড়ে নতুন আধুনিক কিছুতে আগ্রহী হচ্ছে কৃষক। এমনি এক পদ্ধতি ভাসমান সবজি চাষ৷ খরচ এবং ঝামেলা একদম কম থাকায় এটি নিয়ে কৃষকরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের কাশোরারচর এলাকার দিন দিনই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভাসমান সবজি চাষ। কোনো প্রকার রাসায়নিক ছাড়াই জৈব পদ্ধতিতে এ চাষ করায়, উৎপাদন খরচও কম। বিষমুক্ত হওয়ায় বাজারে এ সবজির যেমন চাহিদা, তেমনি ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে উৎপাদনও বেশি হওয়ায়, নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। পানিতে কচুরিপানার ওপর মাটি ছাড়া উৎপাদিত লাউ, শসা, টমেটো, মরিচ, ঢেঁড়স, লালশাক, ফুলকপিসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করছেন, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের কাশোরারচর এলাকার কৃষকরা।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের কাশোরারচর বিলটি বছরের বেশির ভাগ সময় পানিতে পূর্ণ থাকে। এক ফসলি জমির কারণে সেখানে কৃষকদের অভাব-অনটনের মধ্যে থাকতে হয়। তবে তাদের বিকল্প আয়ের পথ খুলে দিয়েছে ভাসমান সবজি চাষ। লাভজনক হওয়ায় বিলে ভাসমান বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন ভূমিহীন কৃষকেরা। এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে একদিকে যেমন পারিবারিক চাহিদা পূরণ করছেন, অন্যদিকে বাজারে বিক্রি করে বেশ আয়ও করছেন ওই কৃষকেরা। এভাবে সবজি চাষে কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিতে হয় না। বিষমুক্ত এসব সবজির চাহিদা বাজারে বেশি থাকায় ভালো দামে বিক্রি করছে চাষিরা। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় এই পদ্ধতিতে সবজি আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। সেইসঙ্গে স্বল্প ব্যয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের কারণে এলাকার অনেক বেকার যুবকরা এই সবজি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বর্তমানে উপজেলায় ২৫ জন ভূমিহীন কৃষক জলাশয়ে ভাসমান খেতে সবজি চাষ করছেন। পানিতে ডুবে থাকা পরিত্যক্ত জমিতে সবজি চাষ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তারা। তাদের দেখে জেলার অনেকে এ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, কয়েক বছর আগে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে ওই বিলে সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেন কৃষক ফয়েজ উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম। পরে দিন দিন তা প্রসারিত হয়ে উঠে। এখন অনেকেই ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া পুরোটাই জৈব পদ্ধতিতে হওয়ায় সবজিগুলো দেখতেও অনেক ভালো হয়। এ কারণে বাজারে ওই সবজির চাহিদাও বেশি। এতে করে এ ইউনিয়নের কৃষকরা নিজেদের ভাগ্য বদল করেছেন। চাষিদের দেখে শিক্ষিত বেকার যুবকদের পাশাপাশি চাকরিজীবীরাও অবসর সময় ভাসমান সবজি চাষে সম্পৃক্ত হয়েছেন।

জানা গেছে, ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা ফসল চাষ, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি অফিস এ বছর মহিনন্দ ও কলাপাড়া ব্লকে ৭৩টি প্রদর্শনী বাস্তবায়িত করেছে। এরই অংশ কাশোরারচর বিলের ভাসমান সবজি বাগান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় , বিলের এক একর পরিমাণ জায়গায় পানির ওপর কৃষকরা তৈরি করেছেন ২০০টি বেড। প্রত্যেকে কাজ বণ্টন করে নিয়ে সবজি বেডের পরিচর্যা করেন। কেউ নৌকা নিয়ে, কেউ পানিতে নেমে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। আর এভাবে বিষমুক্ত সবজি চাষে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা।

কৃষি বিভাগ জানায়, ভাসমান বেডে সবজি চাষ প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০টি। মহিনন্দ ব্লকে বাস্তবায়ন করেছে ১২টি, কলাপাড়া ব্লকে ২৮টি। চলমান রয়েছে ১০টি মসলা প্রদর্শনী। ফ্লিপ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ২০টি, এর মধ্যে ২০টিই কলাপাড়া ব্লকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের বরাদ্দ তিনটি বাস্তবায়ন করা হয় কলাপাড়া ব্লকে। সব মিলিয়ে ৭৩টি প্রদর্শনী এ বিলে বাস্তবায়িত হয়েছে।

২০১২-১৩ অর্থবছরে এই বিলে সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রথমে চংশোলাকিয়ার হারিছ উল্লাহ, ফয়েজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, মজলু, মফিজ ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করেন। বর্তমানে ২৫টি পরিবার বিলের ১ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি আবাদ করেছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, ভাসমান বেডে ৭ থেকে ১০ ম্যাট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ একটি প্রাচীন পদ্ধতি। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণার মাধ্যমে ৭৩টি বেড নির্ধারণ করেছে। ভাসমান সবজি চাষের ফলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়, কীটনাশক লাগে না ও জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একবার বেড তৈরি করলেই সারা বছর সেখানে খুব সহজেই সবজি চাষ করা সম্ভব। লাউ, শসা, করলা, মিষ্টি কুমড়ো এ চার ধরনের সবজি খুব সহজেই এ বেডে চাষ করা যায়। এছাড়াও লাল শাক, ডাটা, ঢেঁড়সসহ অন্যান্য সবজিও চাষ করা যায়। তেমন কোনো সারের প্রয়োজন হয় না। ফলে বিষমুক্ত সবজি জন্মায় এ ভাসমান বেডে। এ জন্য দিন দিন কৃষকরা ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি আবাদে উৎসাহিত হচ্ছেন।

সবজি চাষে প্রায় ২৫টি পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে জানিয়ে কৃষকরা বলেন, তাদের দেখা দেখি জেলার অন্যান্য উপজেলার কৃষকদের মধ্যে ভাসমান সবজি চাষে আগ্রহ বাড়ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার আশপাশসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার চাষি ও কৃষি গবেষকরা এই বিলের ভাসমান সবজি চাষ দেখে আপ্লুত। বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করে চাষিদের পুরস্কৃত করেছেন।

কৃষকরা বলেন, কচুরিপানা জমা করে পচিয়ে লম্বা লম্বা ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। পরে সেখানে চাষ করা হয়েছে শাক সবজি। এ পদ্ধতিতে চাষ করতে বাড়তি কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু জায়গায় বসানো হয়েছে ‘সেক্স ফেরোমন ফাঁদ’। ভাসমান বেডের শাক সবজি জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ, তবে দাম কিছুটা বেশি বলে জানান তারা।

চংশোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা কৃষক আবুল কাশেম বলেন, কাশোরারচর বিলের পতিত ভূমিতে এক যুগ ধরে ভাসমান বেডে সবজি চাষ করে আসছেন তারা। ভাসমান বেডের সবজি বিক্রির টাকায় তাদের পরিবার-পরিজনের ব্যয় নির্বাহ করতে পারছেন। তাদের সাথে এখন অনেক কৃষক সবজি আবাদ করেন।

একই এলাকার কৃষক জমির বলেন, আমার কিছু জমি বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা থাকতো। সেই জমিগুলোতে এখন ভাসমান বেড তৈরি করে শসা, লাল শাক, ঢেঁড়স ও লাউ চাষ করছি। আল্লাহর রহমতে ফলন ভালো হয়েছে। বাজারেও এ সারমুক্ত সবজির চাহিদা বেশি থাকায় অল্প খরচে বেশি লাভ করতে পেরেছি।

কৃষক ফয়েজ উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম জানান, তাদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় তারা ভাসমান পদ্ধতিতে সর্বপ্রথম সবজি চাষ শুরু করে লাভবান হয়েছেন। তাদের দেখা দেখি অনেকেই এখন এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। এতে করে এ ইউনিয়নে পড়ে থাকা জমি ও জলাশয়গুলো এখন সবজিতে ভরে গেছে।

তারা বলেন, কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে স্তূপ করা হয়। পরে বিভিন্ন লতা জাতীয় জলজ গাছ সংগ্রহ করে আস্তে আস্তে স্তর সাজিয়ে এ বেডগুলো তৈরি করা হয়। বেডগুলো ২-৩ ফুট পুরু করে ১০-১২ দিনের মধ্যেই ভাসমান ধাপ বা বেড তৈরি হয়ে যায়। এছাড়াও অনেকে এ বেড তৈরি করতে বাঁশ, নারিকেলের খোসার গুড়া, তুষও ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া এগুলো তৈরি করতে একটি নৌকা বা কলাগাছ দিয়ে তৈরি ভেলা কিংবা তালের ডোঙ্গার (নৌকা) প্রয়োজন হয়। সব কিছু হয়ে গেলে বীজতলা তৈরি করে যে যার পছন্দমতো ভাসমান বাগান তৈরি করেন।

মহিনন্দ ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম জেবুন্নেছা বলেন, ভাসমান সবজি প্রদর্শনী সাত মাসের প্রকল্প। বর্তমানে তিন মাস চলছে। এরই মধ্যে আশাতীত ফল পাওয়া যাচ্ছে। জমির শাকসবজি অতিবর্ষণ, বর্ষা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ভাসমান বেডের শাকসবজির কোনো ক্ষতি হয় না। ফলে জমির শাকসবজির যখন আকাল দেখা দেয়, তখন ভাসমান বেড থেকে বাজারে শাকসবজির জোগান পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে শাকসবজি আবাদ করে কৃষকরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভাসমান বেডে সবজি চাষ ভূমিহীন কৃষকদের নতুন আলো দেখাচ্ছে। ডুমুরিয়ায় যারা ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন, তাদের সবাই ভূমিহীন। নিজের জন্য সবজি উৎপাদন করতে পেরে তারা খুবই খুশি। ওই সবজি দিয়ে একদিকে যেমন তাদের পরিবারের সবজির চাহিদা পূরণ হচ্ছে, অন্যদিকে বাজারে বিক্রি করেও তারা আয় করছেন। এ ছাড়া ওই সবজি সম্পূর্ণ বিষমুক্ত। উৎপাদন খরচও তুলনামূলক অনেক কম। তাই এ পদ্ধতি জেলাজুড়ে দিনে দিনে জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন এবং লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন।