গাইবান্ধায় কেবলমাত্র মাছ ধরতে নালার পানি প্রবাহ বন্ধ করে বাঁধ দেওয়ায় প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উজানের প্রায় এক হাজার বিঘা জমির ফসল। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বীজতলাও। স্থানীয়রা ফসল বাঁচাতে প্রতিবছরই কয়েক দফা করে ওই বাঁধ ভেঙে দিলেও পুণরায় তা দেওয়া হয়। হাজারো বাধা-বিপত্তির পরেও কোনও ভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না ওই স্থানে মাছ ধরার বাঁধ দেওয়া।
বুধবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে ফসল বাঁচাতে পানি নিষ্কাশনের জন্য সর্বশেষ আবারো ওই বাঁধ স্থানীয় জনগণ সম্মিলিতভাবে কেটে দেন। এতে নালার পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে এবং চলমান সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রত্যাশা করছেন কৃষকরা।
এরআগে গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় কৃষকদের ওই নালায় বাঁধ ভাঙার আহ্বান জানিয়ে মাইকিংও করা হয়।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, কয়েক বছর ধরে জেলার সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের পূর্ব রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের খইলসাকুঁড়ি পাথারে একই গ্রামের মজিবর নামের এক ব্যক্তি নালায় পানি প্রবাহ বন্ধ করে মাছ ধরছেন। ফলে এই অঞ্চলে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করছে।
তাদের দাবি, শুধুমাত্র মাছ ধরার জন্য নালা বন্ধ করায় এই অঞ্চলের দুইটি ইউনিয়নের অন্তত এক হাজার বিঘা জমির আমন ধানক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ফসলের কাঙ্খিত উৎপাদন না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃৃষকরা
এছাড়া বীজতলায় জলাবদ্ধতার কারণে সঠিক সময়ে বীজবপণ করা যায় না। যার কারণে সঠিক সময়ে রোপনেও ব্যর্থ হয় কৃষক। অন্যদিকে কোনো কোনো মওসুমে অপরিপক্ক কাঁচা ধানই কাটতে হয় চাষীদের। দফায় দফায় ওই বাঁধ ভেঙে দিলেও আবারো সেখানে বাঁশ, বানা, কাঠ ও মাটি দিয়ে বাঁধ তৈরি করেন মজিবর। সেখানে তার তৈরী বাঁধের একপাশে ঝিরঝির করে পানি ছেঁড়ে দিয়ে সেখানে হেঙ্গাজালি (বাঁশের তৈরি মাছ ধরার এক ধরণের উপকরণ) বসিয়ে মাছ ধরেন।
তারা জানান, সময় ভেদে ওই স্থানে মজিবর প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার দেশি প্রজাতির মাছ ধরেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, পানি নিষ্কাশনের জন্য সাদুল্লাপুর থেকে আসা নালাটি তুলসিঘাট হয়ে পশ্চিম রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে বোয়ালী ইউনিয়নের আলাই নদীতে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে। এই নালার বোয়ালী ইউনিয়নের পূর্ব রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের খইলসাকুঁড়ি নামক পাথারে (হরিপুর ও রেল লাইনের মাঝামাঝিতে) নালার কয়েক স্থানে বিভিন্নভাবে মাছ ধরার ব্যবস্থা করে রেখেছেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন লোক। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় বাঁধ দিয়ে নালার দুই পাড় বরাবর পুরো অংশ জুড়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে মাছ ধরেন স্থানীয় মজিবর নামের ওই ব্যক্তি।
তবে আজ স্থানীয়রা সম্মলিতভাবে নালার ওই স্থানে তার বাঁধ ভেঙে দেওয়ায় নালার পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর জন্য মজিবরের ব্যবহৃত বাঁশ, কাঠ ও বানা সহ বিভিন্ন উপকরণ ওই স্থানে পড়ে আছে। ওই বাঁধ ভেঙে দেওয়ার সময় ক্ষিপ্ত হয়ে বাঁধে ব্যবহৃত বাঁশের খুঁটি, বাঁশও নিয়ে যায় স্থানীয়রা।
এসময় পশ্চিম হরিপুর গ্রামের আব্দুল কাদের বলেন, আমার চার বিঘা জমিতে আমন ধান লাগিয়েছি। মজিবর এখানে মাছ ধরার জন্য বাঁধ দেওয়ার কারণে থোর হওয়া আমন ধানের গলায় গলায় পানি উঠেছে। এভাবে এক সপ্তাহ পানি স্থায়ী থাকলে ক্ষেতের মারাত্মক ক্ষতি হবে। শুধু এবছরই নয়, মজিবর প্রতিবছরই একই স্থানে পানি প্রবাহ বন্ধ করে মাছ ধরায় আমরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই।
পূর্ব রাধাকৃৃষ্ণপুর গ্রামের (আগপাড়া) মধু মিয়া বলেন, সাদুল্লাপুর থেকে শুরু করে বোয়ালী পর্যন্ত কয়েকটি ইউনিয়নের পানি এই নালা দিয়ে বের হয়ে নদীতে যায়। পূর্ব রাধাকৃষ্ণপুরে খইশাকুঁড়ি পাথারের এখানে নালায় বাঁধ দেওয়ায় এই এলাকার দুটি ইউনিয়নের অন্তত ১ হাজার বিঘা জমির ফসল প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমরা কয়েক বার করে এই বাঁধ ভেঙে দেই, আজও ভেঙে দিলাম। কিন্তু পরে আবার দেওয়া হয়। এসময় কৃৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
কৃষক মোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমাদের এই এলাকার একমাত্র চাষাবাদ হয় ধান। বর্তমানে ধান চাষাবাদে বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিকসহ বিভিন্নভাবে প্রচুর পরিমাণে খরচ হয়। এরপরে যদি পানির গতিপ্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে ফসলের কেউ ক্ষতি করে তাহলে কৃষক কেমনে বাঁচবে। এখানে কোনো অনাকঙ্খিত ঘটনা ঘটার আগে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সাবু মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা হয়েছে। তারা সম্মলিতভাবে ওই স্থানের বাঁধটি খুলে দিয়েছে। আমরা ফসল রক্ষায় সেখানে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ আল হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'মাছ ধরতে পানি প্রবাহ বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। যেখানে চাষাবাদ হচ্ছে এবং ফসলের ক্ষতির কারণ আছে সেখানেতো নয়ই। বিষয়টি খতিয়ে দেখে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে'।