গাইবান্ধার সবুজ বাংলা হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গাইবান্ধার সবুজ বাংলা বন্ধের নির্দেশ

গাইবান্ধার সবুজ বাংলা বন্ধের নির্দেশ

গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়ায় সবুজ বাংলা জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সোমবার (২২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় হাসপাতালটি বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার বিষয়টি মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কম-কে নিশ্চিত করেছেন গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. কানিজ সাবিহা।

বিজ্ঞাপন

এর আগে গতকাল ২১ অক্টোবর বিকেলে এই কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত একটি পত্রে হাসপাতালটি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। প্রতিষ্ঠানটি চালুর পর থেকেই চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা অভিযোগের কথা শোনা গেলেও স্বাস্থ্য বিভাগের এবারের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে অভ্যন্তরীণ লোমহর্ষক সব বর্ণনা।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্লিনিক চালানোর মত কোনো পরিবেশই ছিল না সবুজ বাংলা জেনারেল হাসপাতালে। অথচ রোগী ভর্তি করেছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, সিরিয়াস অপারেশনও করেছে। কিন্তু সেসব অপারেশন কোনো চিকিৎসক বা কারা করেছে তার কোনো ডকুমেন্ট নেই। অপারেশন যে ডাক্তারের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওইসব ডাক্তার বিস্ময়ের সাথে জানান, তারা অপারেশন করেননি। অপারেশনের আগে অজ্ঞানের ডাক্তারকেও পায়নি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

শুধু তাই নয়, ক্লিনিকটিতে পাঁচজন নার্স কাজ করলেও বৈধ কাগজপত্র ছিল একজনের। এতো বছর ধরে কীভাবে ক্লিনিকটি চলছে তা বোধগম্য নয় তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

সর্বশেষ দুই মাসের সময় নিয়েও শর্ত পূরণে ব্যর্থও হয়েছে বেসরকারি এই চিকিৎসা কেন্দ্রটি। ফলে ক্লিনিকটি অবশেষে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে গাইবান্ধার স্বাস্থ্য প্রশাসন।

স্বাস্থ্য প্রশাসন ও ক্লিনিকটির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘ দিনের নানা অভিযোগের সূত্র ধরে গাইবান্ধার বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. কানিজ সাবিহাসহ জেলা ও সংশ্লিষ্ট উপজেলার স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি টিম চলতি বছরের গত জুলাইয়ে হাসপাতালটি পরিদর্শনে যাওয়া হয়। সেদিন সরজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে হাসপাতালের কোনো পরিবেশ নেই, রোগী থাকার কোনো পরিবেশ নেই। অপরিচ্ছন্ন এবং অপরিষ্কার একটি চিকিৎসা কেন্দ্র।

এই কর্মকর্তা জানান, পরিদর্শনের দিনে উপস্থিত কোনো চিকিৎসককে হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। সেদিন সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের প্রসূতি ভর্তি ছিল। কোনো চিকিৎসক অপারেশন করেছে জানতে চাইলে তারা অপারেশন করেছেন এমন একজন চিকিৎসকের নাম সম্বলিত একটি রেজিস্ট্রার দেখান। কিন্তু তাৎক্ষণিক তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হই ওই অপারেশন সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না এবং তিনি অপারেশন করেননি।

তিনি জানান, এদিন হাসপাতালের মালিক ডা. রাশেদুন্নবী নিজেকে একজন ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু তার প্রত্যয়ন পাওয়া যায়নি। পরে তাকে সতর্ক করে আগামী দুই মাসের মধ্যে হাসপাতালটির পরিবেশ, পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, যাবতীয় প্রত্যয়ন, চিকিৎসক-নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল এবং লাইসেন্স নবায়নের জন্য সময় বেধে দেওয়া হয়।

কিন্তু দুই মাস পরেও হাসপাতালটির একজন চিকিৎসক সংযুক্ত করা ছাড়া কোনো কিছুরই পরিবর্তন, সংযোজন করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এই কর্মকর্তা আরও জানান দুই মাস পর গত সেপ্টেম্বরে সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্যের ছয় সদস্যের একটি টিম সেখানে অভিযানে যান। যার নেতৃত্বে ছিলেন সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডা. সাজিয়া আফরিন। এছাড়া ওই টিমে সাঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও), সাঘাটার এসিল্যান্ড, সাঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং আরো এক চিকিৎসক ছিলেন। দ্বিতীয় অভিযানের ওই টিম মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৫ হাজার টাকা জরিমানাও করেন বলে নিশ্চিত করেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা।

দুইমাস পর অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তা ও সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডা. সাজিয়া আফরিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, দুই মাস আগের যে হাসপাতাল ছিল নির্দেশের দুইমাস পরেও আমরা একই চিত্র পেয়েছি। তবে, শুধু সেদিন একজন ডাক্তারকে পেয়েছিলাম।

এই কর্মকর্তা জানান, আমরা সেপ্টেম্বরে অভিযান করি। সেইদিন সিজারিয়ারন অপারেশনের তিনজন প্রসূতিকে পাই। তাদের মধ্যে একজনের অপারেশনের সময় সন্তান মারা গেছেন। ওই অপারেশনের ডাক্তারকে পেলেও এ্যানেস্থেসিয়া (অজ্ঞান) চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। কারো নামও বলতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নবায়নের লাইসেন্সও তারা দিতে পারেননি। তারা দাবি করেছিলেন আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু আবেদনের কপিও দেখাতে পারেনি।

সেখানকার পাঁচজন নার্সের মধ্যে একজন নার্সের বৈধ কাগজপত্র পাওয়া গেছে। চারজনের কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি।

এ ব্যাপারে গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. কানিজ সাবিহা মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ওই হাসপাতালটির বিষয়ে ভুল চিকিৎসা, প্রসূতি মৃত্যু, বিশেষ করে অপারেশনকালীন নবজাতক মৃত্যুর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আমিও হাসপাতালটি পরিদর্শন করেছি। আসলে সেখানে চিকিৎসা কেন্দ্রের কোনো পরিবেশ নেই। চিকিৎসক-নার্স নেই। দুইমাস সময় নিয়েও তারা শর্ত পূরণ করতে পারেনি। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে সেখানে তদন্ত এবং একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। ওই টিমের তদন্ত প্রতিবেদন এবং তাদের শুপারিশের ভিত্তিতে আজ সেটিকে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ডাক্তার-নার্স বিহীন অদক্ষ কর্মচারী দিয়ে ক্লিনিক চালানোর কোনো সুযোগ নেই।

উল্লেখ্য: সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর সিভিল সার্জনের কাছে এই সবুজ বাংলা জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসকের ভুল সিজারিয়ান অপারেশনে নবজাতকের মৃত্যু এবং প্রসূতির মূত্রনালী কেটে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ দেন উপজেলার কফিল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি।