ট্রাফিক পুলিশ বনাম অটোরিকশা, যেন ইঁদুর-বিড়াল খেলা!

  • অভিজিত রায় (কৌশিক) স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

রাজধানীর সড়কে চলাচলকারী মানুষের নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ যানজট। আর এই যানজটের প্রধান কারণ সড়কে চলা অটোরিকশার দাপট। যার নেই কোনো বৈধতা। ফলে তিন চাকার এই যানটিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণও হারাচ্ছেন অনেকে।

অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলেও মিলছে না সুফল। মূলত সড়কে পুলিশের উপস্থিতি টের পেলেই অটোরিকশা চালকরা রাস্তা পরিবর্তন করে পালিয়ে যায়। ফলে এসব অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী ট্রাফিক পুলিশের সাথে অটোরিকশা চালকদের ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ চলছে, মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত প্রায় লাখ খানেক অটোরিকশা ডাম্পিং করা হয়েছে। অব্যাহত রয়েছে নিয়মিত অভিযানও।

তবে অভিযান অব্যাহত থাকলেও নিয়ন্ত্রণে হিমসিম খেতে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা সদস্যদের। গেল সেপ্টেম্বর মাসে শুধু রাজধানীতেই ১ সপ্তাহে ২০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ জানাচ্ছে, ২২-২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সাত দিনের অভিযানে ৯ হাজার ৩০১টি অটোরিকশার বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জব্দ করা ৪ হাজার ১৫৯টি রিকশার সিটও।

বিজ্ঞাপন

অভিযানকালে ডাম্পিং করা হয় ৬৬০টি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও জব্দ করা হয় ৩টি রিকশার ব্যাটারি। অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ৫ হাজার ৮৩৯টি রিকশার বিরুদ্ধে । নিয়মিত অভিযান পরিচালনার পরও দিন দিন রাজধানীর সড়কে বেড়েই চলেছে অটোরিকশার দৌরাত্ম্য। যার ফলে ঘটছে নিয়মিত দুর্ঘটনা।

প্রধান সড়কগুলিতে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার দাপট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ কি ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে বা তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার খোন্দকার নজমুল হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ধরতে পারলে আমরা এদেরকে ডাম্পিংয়ে পাঠাচ্ছি। রাজধানীর সড়কে এদের দাপট কমাতে আমরা নিয়মিত অভিযানও পরিচালনা করছি। অভিযানে এদেরকে ধরতে পারলে আমরা ব্যাটারি ডাম্পিংয়ে দিচ্ছি আবার রিকশাও ডাম্পিংয়ে দিচ্ছি। একটা না একটা ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিচ্ছি।’


এখন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে কি পরিমাণ ব্যাটারি বা রিকশা ডাম্পিংয়ে দিয়েছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত প্রায় লাখ খানেক ডাম্পিং করেছি। এই অবস্থাই চলছে আরকি, ইঁদুর বেড়াল খেলা।'

‘এগুলো দেখাতো আর পুলিশের কাজ না’

উৎপাদকদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন-জানতে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা এসব অটোরিকশা তৈরি করছের তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কি পুলিশের কাজ? এদের পারমিশন (অনুমতি) আছে কিনা? এরা বৈধ কিনা? লাইসেন্স ঠিক আছে কিনা? এগুলো দেখাতো আর পুলিশের কাজ না। এই কাজগুলো যাদের; তাদেরই এই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ 

সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা একাধিক কর্মকর্তাদের কাছে অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে তাদের কথা বলার অনুমতি নেই বলে জানান ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা তারা বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। আমাদের কথা বলা নিষেধ আছে। যেকোন বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে গেলে অনুমতি লাগবে।’ 

দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে অন্যতম রাজধানী ঢাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জনশুমারির প্রতিবেদন লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই শহর ও পাশ্ববর্তী জেলায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৫ জন। আর ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর বস্তি শুমারি অনুযায়ী, দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২২ লাখ এবং ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তিতে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজারের মতো। এ হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে ৬ লাখের মতো লোক এসব বস্তিতে বসবাস করেন, যা গত ১০ বছরের ব্যবধানে বহুগুণ বেড়েছে।

রাজধানীর বস্তিতে বসবাসকারী পুরুষের অধিকাংশের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম এই রিকশা। ফলে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের হিসেবের মতই অন্ধকারেই থেকে যায় রাজধানীতে চলাচলকারী রিকশা ও অটোরিকশার সঠিক পরিসংখ্যানও।

সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে রিকশার সংখ্যা কত, এর সঠিক কোনো তথ্য নেই কোনো সংস্থার কাছে।


এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় আনুমানিক প্রায় ৪ লাখেরও অধিক অবৈধ রিকশা ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায়ও প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ অবৈধ রিকশা রয়েছে বলে সূত্র মারফত জানা গেছে।

এছাড়াও রাজধানীর সড়কে প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন নতুন রিকশার চলাচল। এর মধ্যে বড় একটি সংখ্যা ব্যাটারিচালিত। শারীরিক কষ্ট লাঘব করতে রিকশাচালকরা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ফলে মালিক পক্ষও রিকশায় যুক্ত করছেন ব্যাটারি। সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও। গেল (৭ নভেম্বর) বৃহস্পতিবারও রাজধানীর ডেমরা বামৈল এলাকায় অটোরিকশার ধাক্কায় ইউসুফ (৬৫) নামে এক ব্যক্তি প্রাণ হারান।

সমাধান কোন পথে, কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসনে প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান কথা বলেন বার্তা২৪.কম এর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। মামলা দিচ্ছে, কিন্তু এটা সমাধান নয়। আমাদের ঢাকা শহরের আশেপাশে অসংখ্য লোকাল গ্যারেজ রয়েছে। এই লোকাল গ্যারেজগুলো থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদন যদি বন্ধ করা না হয় তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’

‘গ্যারেজগুলো থেকে অবৈধভাবে উৎপাদন করা হয়, সেজন্য গ্যারেজে অভিযান চালাতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশার যে সরঞ্জামগুলো রয়েছে সেগুলোর আমদানি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে না আনলে শুধু সড়ক থেকে রিকশা ধরে লাভ নেই’-বলেন এই  যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। 

সংখ্যায় অটোরিকশার পরিমাণ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা এর উপর নির্ভরশীল, এটিও একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে-মনে করেন ড. মো. হাদিউজ্জামান। 

অটোরিকশা নিয়ে এই সমস্যা রাতারাতি কমানো যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেক্ষেত্রে সরকারের অতি দ্রুত কিছু নীতিমালা তৈরি করা উচিত। প্রথমত, সড়কের সক্ষমতা কতটুকু হবে এবং তার বিপরীতে কি পরিমাণ এধরনের রিকশাকে চলার অনুমতি প্রদান করা হবে-সেটির বিজ্ঞানসম্মত হিসাব-নিকাশ থাকতে হবে। সড়কে তো শুধু ব্যাটারি চালিত রিকশা চলবে না, প্রাইভেটকার থেকে শুরু করে আরো বিভিন্ন ধরনের যান চলাচল করে। সেজন্য সড়কে কি পরিমাণ অটোরিকশা চলবে এই ধরনের নীতিমালা তৈরি করা অতি গুরুত্বপূর্ণ।’

এই সংকট সৃষ্টির পেছনে সরকারের সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠানের দায় দেখন ড. হাদিউজ্জামান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বি আর টি এ অনুমোদন না দেওয়ার কারণে এখন যে যার মতো করে গ্যারেজ তৈরি করছে। সরকারের উচিত একটা স্ট্যান্ডার্ড ডেভলপমেন্ট করা। অটোরিকশাগুলো যেভাবে তৈরি করা হচ্ছে সেখানে তারা বিজ্ঞানসম্মত কাঠামো থেকে অনেক দূরে আছে। এটার কাঠামোগত দুর্বলতা, ডাম্পিংসহ অনেক ধরনের দুর্বলতা রয়েছে, যার ফলে দুর্ঘটনাও ঘটছে। সে জন্য টেকনিক্যাল ইন্সট্রাকশন তৈরি করতে হবে।’

জীবন-জীবিকা নির্বাহে ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করা ৮ লাখ ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার চালকদের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এই পরিচালক বলেন, ‘পরিবারের ৪ জন ধরলেও প্রায় ৩২ লাখ মানুষ এই রিকশার জীবিকার ওপর নির্ভরশীল। পলিসির দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে। সেজন্য অত্যধিক মোটরসাইকেল বেড়ে যাওয়ার পর এখন আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ব্যাটারি চালিত রিকশার একই অবস্থা।’ 


সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবই পরিবহণ খাতে এই বিশৃঙ্খলার কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অটোরিকশা সরঞ্জাম উৎপাদন করা এখন এক ধরনের শিল্প হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ব্যাপার আছে। যে মোটর ও ব্যাটারিগুলো বাহির থেকে দেশে আসছে, সেটা কি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই আসছে-সেই প্রশ্ন তুলছেন তারা। 

‘বিআরটিএ যদিও বলে তারা এটির অনুমোদন দেয়নি এবং এগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করে না, কিন্তু আমি বলবো বিআরটিএ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। ট্রাফিক পুলিশ সড়কে নামার পর অটোরিকশার লাইসেন্স আছে কিনা, বৈধতা আছে কিনা এগুলো তারা চেক করছে। কিন্তু এটার উৎপাদন যেখান থেকে হচ্ছে, যেখানে আমদানি হচ্ছে সেই জায়গায় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ যে সকল স্টেক হোল্ডার রয়েছে তাদের পার্টিসিপেশন থাকতে হবে। কিন্তু এ জায়গায় যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। সেজন্য সংখ্যাগতভাবে এই অটোরিকশা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। এটা ঠেকাতে হলে মূল জায়গা থেকে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুধু সড়ক থেকে সরালে হবে না’-যোগ করেন হাদিউজ্জামান।