ভোলার চরাঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম, ভোলা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

উপকূলীয় জেলা ভোলার চরাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ। আক্রান্তের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি।

সূত্রমতে, জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন জেলাগুলোর মধ্যে গাঙ্গেয় দ্বীপের জেলা ভোলা অন্যতম। এখানে প্রতিবছর লবণাক্ততার কারণে ফসলের উৎপাদন কমছে, বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে যাচ্ছে বহু লোকালয়, জনপদ। ফলে এখানকার বিপন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার সঙ্গে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ঝুঁকিও বাড়ছে দিনদিন। বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রকট আকার ধারণ করছে।

বিজ্ঞাপন

দ্বীপ জেলা ভোলা সদর থেকে প্রায় দু'শ' কিলোমিটার স্থল ও জলভাগের দূরত্বে অবস্থিত প্রান্তিক চরজনপদ ঢালচর। সেখানে দেখা যায়, নারীরা কাঁদামাটিযুক্ত হয়ে খালে ডুবে মাছ ধরছেন। তাদের মধ্যে একজন ৩৮ বছর বয়সী নারী জমিলা খাতুন। এক মেয়ে আর তিন পুত্র সন্তানের জননী সে। নোনা পানিতে মাছ ধরার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তার। শীত মৌসুম আসলেই মাছ ধরার ব্যস্ততা শুরু হয় জমিলার। স্বামী হযরত আলী মাঝি সাগরে গিয়ে মাছ ধরে আনতে পারলে দু'বেলা আহার জুটে, নচেৎ খালে-বিলে মাছ ধরে সংসারের বাকি ঘানি টানতে হয় জমিলাকেই। প্রতিদিন মাছের সঙ্গে বিষাক্ত নোনা পানির ছোবলে যে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ফেটে চৌচির ও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে সেদিক কোনোপ্রকার খেয়ালই রাখেন না জমিলা।

শরীরের যত্ন নেয়া কিম্বা ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেনো জানতে চাইলে শ্রমজীবী নারী জমিলা বলেন, পেটে ভাতই জুটেনা,ডাক্তার দেহায়া ওষুধ খামু ক্যামনে? সবই আল্লার উপরে ছাইর‌্যা দিছি। বিশোর্ধ্ব অপর নারী লাইলী বেগম কোমরে গামছা বেঁধে খালি পায়ে কাস্তে হাতে নিয়ে চরের জমিতে অন্য নারীদের সঙ্গে ধান কাটছিলেন। মুখে মেছতা পরে বিবর্ণ চেহারা, পায়ে লাল, কালো আর খয়রী বর্ণের অসংখ্য চর্ম দাগ তার।

বিজ্ঞাপন

এক কন্যা সন্তানের মা লাইলী বেগম বলেন, কবিরাজের কাছে গেছি; শালশা বানায়া দিছে।

হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার কেনো দেখাচ্ছেন না এমন প্রশ্ন করলে লাইলী বেগম বলেন, এডা ডাক্তারী রোগ না। এইটা বদ জ্বীনের আছর (আক্রমণ)। আরেক নারী মাইমুনাকে দেখা গেছে,পুকুর থেকে কলসিতে পানি ভরতে। পুকুরের পানি নিচ্ছেন কেনো, জিজ্ঞেস করলে মাইমুনা বলেন,পানির কল দুই মাইল দূরে।

জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে উপকূলের চরাঞ্চলে জমিলা, মাইমুনা আর লাইলী বেগমদের মতো এমন অসংখ্য শ্রমজীবী নারী স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়ে ভ্রান্ত ধারনায় নিজের জীবন বিপন্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয়, নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সেখানকার বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট্রের সমন্বয়করী রাশিদা বেগমের সঙ্গে তিনি জানান, উপকূলীয় জেলা ভোলার নদী ও সাগরকূলের জনপদ ঢালচরসহ অন্যান্য সকল চর এলাকার পানির লবণাক্ততা ও সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা একই মাত্রার। যার প্রভাব পড়েছে নারীর স্বাস্থ্যে। নারীরা কোমরপানিতে নেমে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা নানান মাছ ও চিংড়িপোনা সংগ্রহ করেন। চর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীরা সহজে স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পান না। সুপেয় পানির জন্য তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। নিজে লবণাক্ত পানি খেয়ে বা কম পানি খেয়ে পরিবারের অন্যদের পান করার জন্য পানি রাখেন। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগ, প্রি-একলাম্পশিয়া এমনকি গর্ভপাতের শিকার হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওআরএস বা প্যাকেটজাত মুখে খাওয়ার স্যালাইন দক্ষিণাঞ্চলে ততটা কার্যকর নয়।’

তিনি বলেন, পরিবারের পুরুষ যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়েন, নারীরা তখন রয়ে যান পেছনে পুরো পরিবার নিয়ে; পরিবারের ছোট বাচ্চা, কিশোরী মেয়ে, বয়স্কদের দায়িত্ব নিতে হয় তাদের।

এ বিষয় আরো কথা হয়, জলবায়ু ফোরামের ভোলা জেলা সমন্বয়ক আবু সিদ্দিক'র সঙ্গে তিনি‘ বলেন, সমুদ্রে ডুবোচর জাগছে। মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সংসারের পুরুষটিকে আরও গভীর সমুদ্রে যেতে হয়। নিরাপত্তার কথা ভেবে কিশোরী মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে যেতে হয়। কিশোর ছেলেটিকে দিতে হয় ইটভাটায় বা অন্য কোনো কাজে। কখনও পুরো পরিবার মিলে ইটভাটায় কাজ করে জেলেদের দাদনের টাকা শোধ করতে হয়। কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনাপানিতে দাঁড়িয়ে মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হয়। এ ঘটনাগুলো ভোলা উপকূলীয় এলাকার নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের জেলে পরিবারের নারীদের।’

বিষয়টি নিয়ে কথা ঢালচর ইউপি সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আাব্দস সালাম হাওলাদারের সঙ্গে তিনি জানান, চরের এসব নারীদের অধিকাংশই তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীন।

এ বিষয়ে ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মনিরুল ইসলাম বার্তা ২৪ 'কে বলেন,‘জলবায়ু পরিবর্তনের আরও একটি অভিঘাত হচ্ছে ক্রমেই তাপপ্রবাহ বেড়ে চলা। ফলে অত্যধিক তাপপ্রবাহ নারীর হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। আবার এ তাপপ্রবাহের মধ্যে রান্না ঘরে অনেকটা সময় কাটাতে হয়, যেখানে ধোঁয়া ও তাপ ছাড়াও পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে নারীরা হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া পোশাকের কারণে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীর মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি থাকে।’ তিনি বলেন, এখানকার ৪০ শতাংশ নারী ও কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোলার সাগর মোহনার চরজনপদ চরফ্যাশন উপজেলায় জনবসতিপূর্ণ, চর ফকিরা, ঢালচর, চর লিউলিন, কুকরি মুকরি, চর পাতিলাসহ ছোট-বড় প্রায় ১১টি চর রয়েছে। এসব চরগুলো মূল ভূ-খন্ড থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। এছাড়া এখানকার উপকূলীয় চর সমূহের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করছে অসংখ্য কিশোর-কিশোরী ও শ্রমজীবী নারী-পুরুষ। এসব চরাঞ্চলে অধিকাংশই শারীরিক পরিচর্যায় রয়েছে অসচেতন, এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে অসংখ্য নারী-কিশোরীরা। তাই এদের পরিচর্যায় বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন উপকূলবাসী।